হিন্দু ধর্মে পিতৃপক্ষ এক গূঢ় আধ্যাত্মিক কাল। বিশ্বাস করা হয়, এই সময় পিতৃলোকের দ্বার খুলে যায় এবং পূর্বপুরুষেরা মর্ত্যে নেমে আসেন। তাঁরা অপেক্ষা করেন সন্তানের তর্পণ, পিণ্ডদান ও শ্রাদ্ধের আহ্বানের জন্য। যে পরিবার ভক্তি ও শাস্ত্রবিধি মেনে এই আচার সম্পন্ন করে, তাদের জীবনে আসে শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি।
পুরাণে উল্লেখ আছে, কর্ণ যখন স্বর্গলোকে গেলেন, তখন তিনি সোনার থালা পেলেন খাদ্য হিসেবে। কারণ জীবিতকালে তিনি দান করেছিলেন স্বর্ণ ও ধনরত্ন, কিন্তু কখনও খাদ্য দান করেননি। তখন কর্ণ প্রার্থনা করেন পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে পিতৃপক্ষের কালে খাদ্য দান করবেন। ভগবান যম তাঁকে অনুমতি দেন এবং কর্ণ মর্ত্যে ফিরে এসে অসহায়দের ভোজন করান। সেই থেকে পিতৃপক্ষের খাদ্যদান ও ব্রাহ্মণভোজনের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়।
এই সময়ে প্রতিটি পরিবারে নিয়ম রয়েছে পূর্বপুরুষের মৃত্যুতিথিতে শ্রাদ্ধ পালন করার। কালো তিল, যব ও জল দিয়ে তর্পণ করা হয়, আর সঙ্গে থাকে পিণ্ডদান। শাস্ত্র মতে, ব্রাহ্মণ ভোজন না হলে গরু বা অসহায় মানুষকে ভোজন করানোও সমান পুণ্যদায়ক। ঘর রাখতে হয় পবিত্র ও নির্মল, যেন আগত পিতৃলোক সন্তুষ্ট হন।
কিন্তু এই পবিত্র কালে কিছু কাজ সম্পূর্ণ বর্জনীয়। শাস্ত্রে বলা আছে, পিতৃপক্ষে আমিষ ভোজন, মদ্যপান ও তামসিক জীবনযাপন থেকে বিরত থাকতে হবে। বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, নতুন ব্যবসা শুরু কিংবা নতুন বস্ত্র–গহনা ক্রয় করা উচিত নয়। এমনকি প্রচলিত বিশ্বাসে বলা হয়, এই সময় নখ বা চুল কাটা থেকেও বিরত থাকা উচিত। কারণ এগুলোকে ধরা হয় পূর্বপুরুষের অসম্মান হিসেবে।
পিতৃপক্ষ শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, এটি এক আত্মিক যোগসূত্র। সন্তান যখন পূর্বপুরুষের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ করে, তখন শুধু তাঁদের আত্মাই শান্তি পায় না, বরং পরিবারের উপর থেকে দুর্ভাগ্যের ছায়াও দূর হয়। মহাভারতেও আছে বর্ণনা, যুদ্ধের আগে পাণ্ডবরা পিতৃপক্ষের তর্পণ করেছিলেন পূর্বপুরুষের আশীর্বাদের জন্য।
এই ১৫ দিনের কাল তাই ভক্তির সঙ্গে পালন করা অপরিহার্য। বিশ্বাস, নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করলে পিতৃলোক সন্তুষ্ট হন, আর তাঁদের আশীর্বাদে জীবনের অন্ধকার কেটে আসে আলো, দূর হয় দুঃখ ও কষ্ট।