নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত
একসময় যিনি ছিলেন সিংহাসনের সর্বেসর্বা, ক্ষমতার পাদপীঠে দাঁড়িয়ে এক জাতিকে পরিচালনার দম্ভে পূর্ণ, আজ তিনি এক প্রান্তিক মানুষ, যিনি হঠাৎ করেই ইতিহাসের হিমস্রোতে হারিয়ে গেলেন। ঠিক যেন কোনো কাব্যিক নির্মমতা। নেপালে যা ঘটেছে, তা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং এক জীবন্ত উদাহরণ, কীভাবে জনতার বিশ্বাস ভাঙলে, সিংহাসনও বালুর বাঁধ হয়ে ভেঙে পড়ে। রাজনীতি কখনও ন্যায্যতার আশ্রয়স্থল নয়, বরং এক অনিশ্চিত খেলাঘর। যে এখানে আজ রাজা, সে কাল হতে পারে রাস্তার একাকী পথিক, মুখে কেবল শোকের ছায়া। ২০২৫ সালের নেপাল যেন ইতিহাসেরই এক নির্মম পুনরাবৃত্তি যেখানে ক্ষমতার মঞ্চে বসে থাকা একজন নেতা, এক মুহূর্তে রূপান্তরিত হন এক নিঃস্ব মানুষের ছায়াচিত্রে।
নেপালের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান, রক্তক্ষয়ী প্রতিবাদ, সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞা, সেনাবাহিনীর মোতায়েন সব কিছু যেন মিলে গেছে এক রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির অন্তিম দৃশ্যরচনায়। এই নাটকীয়তার কেন্দ্রে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। যিনি ভাবতেন, ক্ষমতা হলো অটুট। যিনি বিশ্বাস করতেন, চাইলেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তরুণদের কণ্ঠ রোধ করতে চায়, তখন তার প্রতিক্রিয়া হয় আগ্নেয়গিরির মতো-শান্ত, অথচ ধ্বংসাত্মক।এই আগুনের নাম- জেনারেশন জেড। তারা চুপ থাকেনি। তারা ভয় পায়নি। তারা সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যান দেখে বুঝে গিয়েছিল, শুধু ইন্টারনেট নয়, চেপে ধরা হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের স্বপ্ন, তাদের কণ্ঠস্বর। কাঠমান্ডুর রাজপথে তাই তারা এসেছিল হাতের ফোন ফেলে, বুক পেতে। সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনে নেমেছিল গুলি, রক্ত ঝরেছিল রাস্তার পিচে, উড়ে গিয়েছিল জাতীয় পতাকার পাশ দিয়ে মায়ের কান্না।
রাজা তখনও বুঝলেন না। তাঁর রাজ্য জ্বলছে, আর তিনি বিশ্বাস করলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কিছু দিন আগেও যিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের মুখপাত্র হয়ে আত্মবিশ্বাসে কথা বলতেন, তিনিই এখন দেশবাসীর চোখে একজন ক্ষমতা-পিপাসু, সত্যবর্জিত প্রতিমূর্তি। তার পতন ছিল অবধারিত। যখন সংসদের গেট ভেঙে ঢুকে পড়ে ক্ষুব্ধ জনতা, যখন স্কুলপড়ুয়া তরুণেরা রাস্তায় লাঠির মুখে জবাব দেয় অগ্নিকণ্ঠে, তখনই লেখা হয়ে গিয়েছিল পতনের পাণ্ডুলিপি।
এক সময়, এই একই মানুষ ছিলেন জনতার নেতা। তিনিই আজ সেই জনতার রোষানলে বিপর্যস্ত, পদত্যাগ করতে বাধ্য। আজ তিনি শুধুইটি ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠা, যেখানে লেখা থাকবে, কিভাবে একটি নিষেধাজ্ঞা জ্বালিয়ে দিয়েছিল জনতার বিশ্বাস। কিভাবে তরুণদের তীব্র প্রতিবাদ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক সময়ের রাজাকে।
কিন্তু এটা একজন নেতার পতনের গল্প নয়। এটা একটি রাষ্ট্রের আত্মপুনর্গঠনের ইঙ্গিত। ক্ষমতা যখন জনমতের ওপর দাঁড়ায় না, তখন তা হয় অবিশ্বাসের স্থাপত্য। নেপাল এখন দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন ভোরের দ্বারপ্রান্তে, যেখানে পুরোনো মুখ আর নীতির মৃত্যুতে জন্ম নেবে নতুন আশার।
আজকের নেপাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেউই চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়। আর রাজা যদি জনতার হৃদয় হারিয়ে ফেলে, তাহলে তার রাজসিংহাসন মুহূর্তেই হয়ে যায় ভাঙা মঞ্চ, যেখানে করতালির বদলে শোনা যায় ধ্বংসের পদধ্বনি।
নেপালের এই অধ্যায় কেবল তাদের নিজের ইতিহাস নয়, এটি এক বৈশ্বিক বার্তা। সাধারণ মানুষ চাইলে যে সব কিছু করতে পারে, তারা শাসকের সিংহাসন হটিয়ে দিতে পারে, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, পরিবর্তনের বীজ বপন করতে পারে। নেপালের তরুণ সমাজ তা করে দেখিয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে, যখন জনতার কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়, তখন সেই কণ্ঠই বজ্রের মতো ফেটে পড়ে আকাশে-বাতাসে। মানুষ চাইলেই পারে! তা সে নেপালের গলি হোক, কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মাটি!