স্বর্গের দ্বার খুলে গিয়েছিল এক অলৌকিক প্রহরে, যখন বিষ্ণুর বামন অবতার তাঁর তৃতীয় পদ ফেলে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন আকাশের শেষ সীমা। সেই পদাঘাতে সৃষ্টি হয়েছিল এক ফাটল, এক সৃষ্টিচ্ছেদ, যার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল এক বিশুদ্ধ, দেবসঞ্জাত, স্ফটিকপ্রভা জলধারা। এই ধারা ছিল না কোনও সাধারণ নদী, ছিল এক দেবী! গঙ্গা, যাঁর আত্মা তখনও জলরূপে বন্দি, স্বরূপে উদ্ভাসিত নয়।
তাঁর আগমনের কারণ ছিল এক রাজর্ষির কঠোর তপস্যা, এক পুত্রসন্তানের কর্তব্যবোধ। ভগীরথ নামের সেই রাজা, যাঁর পূর্বপুরুষেরা পুড়ে ছাই হয়ে ঘুরছিলেন মর্ত্যের পথে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। তিনি তাঁর অদম্য ইচ্ছা দিয়ে কাঁপিয়ে তুলেছিলেন ব্রহ্মার আসন। ব্রহ্মা গঙ্গাকে দিলেন পৃথিবীতে নামার অনুমতি, কিন্তু এই প্রবাহকে ধারণ করবে কে, তা নিয়ে ছিল সংশয়। তখন ভগীরথ আশ্রয় নিলেন মহাদেবের, যিনি বিশ্বসংহার ও সৃষ্টির মধ্যমস্বর। গঙ্গা তখন তাঁর স্বর্গীয় রূপে, রুদ্র রোষে, মহাপ্রলয় হয়ে নামতে উদ্যত। তিনি নামছিলেন, যেন এক বিষণ্ণ ক্রোধের স্রোত, যাঁর গতি থামানো অসম্ভব। কিন্তু শিব তাঁকে আবদ্ধ করলেন তাঁর মস্তকে, জটাজালের অন্ধকারে। সেই জটা হয়ে উঠল গঙ্গার গর্ভ, যেখানে তিনি ধীরে ধীরে শান্ত হলেন, তীব্রতা হারিয়ে পেলেন ধরণীর ছোঁয়া। শিবের মন্দ্র ঔদার্যে গঙ্গা পরিণত হলেন ধরা ছুঁয়েও অলৌকিকতায় মগ্ন এক দেবীজলধারায়। ভগীরথের রথের চাকা ঘুরল, আর গঙ্গা বইলেন পাহাড় থেকে সমতলে, পুরাণ থেকে বর্তমানের দিকে। কোথাও তিনি ভাঙলেন পর্বতের বক্ষ, কোথাও গড়লেন উপত্যকার রূপ। পথের শেষে এসে তিনি ছুঁয়ে দিলেন সেই পবিত্র ভস্ম! রাজা সগরের ষাট হাজার পুত্রের অস্থি, যাঁরা অভিশপ্ত হয়ে ধরণীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। গঙ্গার স্পর্শে মিলল তাঁদের মুক্তি, শান্ত হল আত্মা, বন্ধ হল পাপের চক্র।
তাঁর নাম হয়ে গেল মোক্ষদায়িনী, পাপনাশিনী, ত্রিভুবনের গঙ্গা। যিনি স্বর্গে মন্দাকিনী, মৃত্যুলোকে ভাগীরথী। তাঁকে নিয়ে পুরাণে রচিত হল শত শত স্তোত্র, যুগে যুগে মহাপুরুষেরা শ্রদ্ধায় অবনত হলেন।
শান্তনু নামের এক রাজা একদিন নদীতীরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন গঙ্গাকে। গঙ্গা তখন রূপে অপরূপা, দৃষ্টিতে গম্ভীর, আত্মায় দ্যুতিময়ী। শান্তনু মুগ্ধ হয়েছিলেন, প্রেমে পড়েছিলেন। গঙ্গা এসেছিলেন তাঁর জীবনে, সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, আবার একে একে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সন্তানদের জলে সমর্পণ করে। আটবারের সেই বিসর্জনের শেষে গঙ্গা চলে গিয়েছিলেন, রেখে গিয়েছিলেন এক মহাপুরুষকে! ভীষ্ম, যিনি হবেন কুরুর ইতিহাসের মূল স্তম্ভ।
এই ছিল গঙ্গার মর্ত্যে পদার্পণ, প্রেম, মাতৃত্ব, দায়িত্ব এবং অভিমানের আখ্যান। তাঁর স্রোতে একাধারে ছিল ধ্বংস আর সৃজন, শান্তি আর বিদ্রোহ, মাতৃত্ব আর তপস্যা। নদী হয়ে তিনি শুধু ভূমির ক্ষুধা মেটাননি, মনের পাপও ধুয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সেই গঙ্গা আজ বোঝা বইছেন মানুষের লোভ, শহরের নোংরা, ধর্মের নামে, ভক্তির নামে দূষণ। তাঁর জলে মিশে গেছে বিষ, আর তাঁর ঢেউয়ে শোনা যায় না সেই পুরাতন স্তোত্র, কেবলই ক্লান্তির শব্দ। তবুও তিনি বইছেন, কারণ দেবতা তো কখনও পিছু হাঁটেন না। তিনি প্রতীক্ষা করছেন, আবার এক ভগীরথ আসবেন, যিনি শুধুই রাজা হবেন না, হবেন বাঁচানোর প্রতীক। তখন হয়ত আবার এক নবজন্ম হবে গঙ্গার, যেখানে তিনি হবেন স্বচ্ছ, দুর্বিনীত, দীপ্ত এক দেবী, যেমন তিনি একদিন ছিলেন, যেমন তিনি চিরকাল আছেন, যেমন তিনি থাকবেন, যতদিন পৃথিবীর বুকে পুরাণের ধারা বয়।
গঙ্গা শুধু নদী নয়, গঙ্গা সেই প্রবাহ, যার স্পর্শে ধুয়ে যায় ইতিহাস, জন্ম নেয় কাব্য, আর জীবিত হয় দেবত্ব।