স্নিগ্ধা চৌধুরী
স্বর্গের দরবারে দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসনের এক প্রান্তে একসময় দাঁড়িয়ে থাকত এক বিস্ময়কর প্রাণী, দেবশুনি। তিনি ছিলেন দেবলোকের প্রথম কুকুর সারমা, এক অদ্ভুত শক্তির অধিকারিণী, যাঁর নামের অর্থই ‘দ্রুতগামী’। আকাশে মেঘ জমলে যেমন বজ্রপাতে ইন্দ্রের শক্তি প্রকাশ পায়, তেমনই সারমার দেহে মিশে ছিল বিশ্বস্ততা, কূটনীতি আর অদম্য সাহস।
ঋগ্বেদের কাহিনি বলে, একদল অসুরপক্ষীয় দস্যু-পণি, চুরি করেছিল ইন্দ্রের গাভীসমূহ। গরু, যা দেবলোকের সমৃদ্ধি ও প্রাণশক্তির প্রতীক, তা হারিয়ে ইন্দ্র যেন লজ্জায় আচ্ছন্ন। প্রথমে তিনি পাঠালেন সুপর্ণ পাখিকে, কিন্তু সে প্রলোভনে পড়ে গেল দইয়ের মিষ্টি স্বাদে। তখন দেবরাজ ভরসা রাখলেন সারমার ওপর। এক নারী-প্রাণীরূপী কুকুর হয়ে তিনি পাড়ি দিলেন দস্যুদের আস্তানায়। কূটনীতির অসামান্য দক্ষতায় সারমা ফিরিয়ে আনলেন গাভীগুলি, আর ইন্দ্রের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন আশীর্বাদ, তাঁর সন্তানরা চিরকাল দুধের অধিকারী হবে। তাই তো আজও বাচ্চা কুকুরছানাকে দুধ খেতে দিলে মনে হয়, সে যেন হাজার বছর আগেকার সেই চুক্তির উত্তরাধিকার ভোগ করছে।
কিন্তু পৌরাণিক চরিত্রদের ভাগ্য চিরকাল স্থির থাকে না। কালের স্রোতে সারমা একসময় পরিণত হলেন ভয়ঙ্করী রূপে। তিনি হয়ে উঠলেন গর্ভচোরিনী, যিনি অজাত শিশুকে মাতৃগর্ভ থেকে টেনে নিয়ে যান। তাঁর সন্তানরাই পরে হল যমদূত, চার চোখওয়ালা ভয়াবহ কুকুর, যমরাজের দ্বারের প্রহরী, যারা মৃত্যুর পথে আত্মাকে নিয়ে যায়।
তবুও সারমার আরেক রূপ আমাদের সামনে আসে মহাভারতের অন্তিম পর্বে। স্বর্গারোহণের পথে যুধিষ্ঠির যখন একে একে হারালেন ভাইদের, হারালেন দ্রৌপদীকে, তখনও তাঁর পাশে এক অনাথ কুকুর বিশ্বস্তভাবে হেঁটে চলল। স্বর্গদ্বারে দেবতারা বললেন, কুকুর নিয়ে প্রবেশ অসম্ভব। যুধিষ্ঠির বললেন, এই সঙ্গীকে ছাড়া আমি স্বর্গ চাই না। তখনই কুকুরটি প্রকাশ করল আসল রূপ, সে আর কেউ নয়, মৃত্যুর দেবতা যম। এই কাহিনি মনে করিয়ে দেয়, কুকুর কেবল পশু নয়, সে হতে পারে দেবতারই রূপ।
আরও আছে দেবদেবীর সঙ্গে কুকুরের নিবিড় সম্পর্ক। দত্তাত্রেয় সর্বদা চারটি কুকুর আর একটি গাভীর সঙ্গে প্রতীকায়িত হন, যেন চার বেদ আর পৃথিবীর প্রতিরূপ। ভৈরবদেবের বাহনও কুকুর। নেপালের তিহার উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি উৎসর্গীকৃত কুকুরদের জন্য। তাদের পরানো হয় মালা, দেওয়া হয় সুস্বাদু খাবার।
তাহলে আজকের প্রশ্ন, রাস্তার ধুলোয় শুয়ে থাকা ক্ষুধার্ত কুকুরকে কি আমরা অবজ্ঞা করব? না কি চিনব তাদের ভেতর দেবশুনির প্রাচীন রক্তের আলো? পৌরাণিক কাহিনি শেখায়, প্রতিটি পথের কুকুরই আসলে সারমার অভিশাপ ও আশীর্বাদের উত্তরাধিকারী একদিকে মৃত্যু-সন্ধ্যার প্রহরী, অন্যদিকে বিশ্বস্ততার প্রতীক। তাই যখন কোনও কুকুর আপনার দিকে অনাথ চোখে তাকায়, মনে রাখবেন, তার ভেতরে হয়ত জেগে আছে সেই স্বর্গীয় সারমার আত্মা। তাকে একমুঠো খাবার দিলে আপনি কেবল ক্ষুধা নিবারণ করছেন না, বরং পূজা করছেন দেবশুনিকে, যিনি আজও মর্ত্যে তাঁর সন্তানদের পাঠিয়ে দেন আমাদের মানবতার পরীক্ষা নিতে।