ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন বাঙালি প্রবাসী দম্পতি। উজবেকিস্তানে গিয়ে পথ ভুল করে অন্য পথে চলে গিয়েছেন ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাঙালি দম্পতি প্রবীর মিত্র ও সংযুক্তা মিত্র। তখন তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁদের ১০০ দিনের প্রায় ২৭,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাযাত্রায় বোধ হয় আবারও বড় বাধা এল। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, ৪৩০ কিলোমিটার ভুল পথে চলে যাওয়া তাঁদের যাত্রার সবচেয়ে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা এনে দেবে।
ইংল্যান্ডের কিংস লিন থেকে কলকাতার পথে, প্রাচীন সিল্ক রোড ধরে ২০টি দেশ অতিক্রম করার সময় তাঁরা পৌঁছে যান এক দূরবর্তী গ্রাম। গ্রামের নাম কিজিল কালা। আসলে তাঁদের গন্তব্য ছিল কারাকালপাকস্তানের প্রথম শতকের ঐতিহাসিক কিজিল কালা দুর্গ। যা তাঁরা ভাবেননি, সেটাই ঘটে গেল। গ্রামের মানুষজন তাঁদের বাবরের দেশ থেকে আসা অতিথি হিসেবে অভ্যর্থনা জানালেন। বাবর ছিলেন ১৫ শতকের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আজকের উজবেকিস্তানে জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত।
একজন গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তাঁদের জড়িয়ে ধরলেন, যথারীতি এলো দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ। মুহূর্তেই দুই পথহারা বাঙালি ভ্রমণকারী হয়ে গেলেন কোন এক অজানা অচেনা গ্রামের সম্মানিত অতিথি। সংযুক্তা মিত্র বললেন, “যেভাবে আমাদের স্বাগত জানানো হয়েছিল, তা অবিশ্বাস্য। আমরা অপরিচিত থেকে এমন এক দেশের প্রতিনিধি হয়ে গেলাম, যাঁরা ভারতের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল।”
এই ঘটনায় বিদ্রূপও ছিল। তাঁরা চলেছেন এমন এক গাড়িতে যার নাম চেতক, মহারাণা প্রতাপের ঐতিহাসিক যুদ্ধ-ঘোড়ার নামেই নাম রাখা হয়েছে গাড়ির। অথচ মহারাণা প্রতাপ ১৫৭৬ সালে হালদিঘাটির যুদ্ধে বাবরের উত্তরসূরিদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তবুও শতাব্দী পরে বাবরের নামেই মধ্য এশিয়ায় তাঁদের জন্য খুলে গেল দরজা, সঙ্গে হৃদয়।
মিত্র দম্পতির যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাস খোঁজা নয়, বরং মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতনতা ছড়ানো। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে মানুষ জিনগতভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হন। প্রবীর মিত্র, একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ। তিনি বললেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলা, স্বাস্থ্য তথ্য ভাগ করে নেওয়া এবং এমন জীবনযাত্রা প্রচার করা যাতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে।”
তাঁদের যাত্রার শেষে বড় বিপত্তি ঘটে। নেপালের তিব্বত সীমান্তের কাছে কাঠমান্ডু থেকে ১৪৪ কিলোমিটার দূরে কোদান গ্রামে ভূমিধস হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের প্রিয় গাড়ি চেতককে সেখানেই রেখে তাঁরা ট্রেকে উঠে কাঠমান্ডু যান এবং পরে দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। প্রবীর মিত্র বলেন, “চেতককে ফেলে আসা আমাদের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। তবে রাস্তা খুললেই আমাদের সঙ্গীকে ফিরিয়ে আনব।”
এই যাত্রার পরিকল্পনা করতে তাঁদের লেগেছিল পাঁচ বছর। প্রবীর মিত্রর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সংযুক্তা মিত্র। তিনি একজন গণিত শিক্ষিকা ও কিংস লিন-এর কিং এডওয়ার্ড সপ্তম একাডেমির পরামর্শদাতা। তাঁদের এই বিশেষ যাত্রাকে সমর্থন করেছে রোটারি ক্লাব অফ কিংস লিন, রোটারি ক্লাব অফ ক্যালকাটা মেট্রো সিটি এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনাল। সম্রাট বাবরের দেশের মানুষ হিসেবে উজবেকিস্তানে মিত্র দম্পতির পাওয়া এমন আতিথেয়তা সত্যিই অবাক করার মতো।