পুজোর গান বলতে কি বোঝায়, এ কালের মল পিভিআর ৱ্যাপ রিমিক্স সুফিতে নিমজ্জিত তরুণ প্রজন্ম তা জানে না। জানার কথাও নয়। রামনিধি গুপ্ত বলতেন হাওয়া হলো সবের নিয়ন্ত্রক। তিনি রসিক, রসিয়ে বলেছেন। সে রসের ময়নাতদন্ত করলে সামনে আসবে দুটি শব্দ : রুচি আর সময়। মধ্যবিত্ত মানসিকতার কথাসুরের যুগলবন্দির জন্য অপেক্ষায় থাকার দিন আজ আর নেই। উৎসবের মুখে পুজোর গানের গৌরব তাই অন্তর্হিত। বোধনের আগে ভাসান। আসলে অপেক্ষার দিবসরজনীর চরিত্র বদলেছে। ধৈর্য বস্তুটি নেই। রাত চারটের সময় ইচ্ছে হলে আপনি বাড়িতে আনিয়ে নিতে পারেন ফিশ ফ্রাই থেকে চাইনিজ যে কোনো আইটেম। নিজে উদ্যোগ নিয়ে নিজেরই ইউ টিউব চ্যানেলে প্রকাশ করতে পারেন গান কবিতা নাটক। এই সহজলভ্যতা খালি গানে নয়, চিরন্তন সবকিছুতে বসিয়েছে থাবা। একবার পিছনে ফিরে তাকানো যাক। “পৃথিবী আমারে চায়”,”মধুর আমার মায়ের হাসি”,”রানার”– নানা বছরে পুজোয় প্রকাশিত এই তিন কালজয়ী গানে গীতিকারেরা ছুঁতে চেয়েছেন সনাতন মূল্যবোধকে। দেশপ্রেমের আবেগ মানবিক প্রেমের আগে , প্রথম গানটিতে মোহিনী চৌধুরী সেই বার্তা দিয়েছেন। আমাদের ঘরের মা সর্বোত্তমা, আমাদের গড়ে ওঠার পেছনে যাঁর অবদান সর্বাধিক। প্রণব রায় লিখেছেন সেই অমরকথা। প্রতিবাদী সুকান্ত ভট্টাচার্য রানারের জীবনের সুখদুঃখ এঁকেছেন কলমে। কালজয়ী সুরকারেরা সুর করেছেন। সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন সেইসব গান। হৃদয়েরই গান হয়ে উঠেছে তা। শ্রোতা হয়েছেন সংলগ্ন। আর আজকের ছবি? দেশের গোপন নথি বেচে দিতে পিছপা নয় অনেকেই , মা আজ বৃদ্ধাশ্রমে, রানারকে দৌড়োতে হয়না। তার বদলে দৌড়োয় কুরিয়ারের গাড়ি। মরমী গান কি আর আকাশ থেকে পড়বে? তাই পুজোর গানের জায়গায় এখন এসেছে সিঙ্গলস।একটি গান, সেখানে সবই দৃশ্যমান। গান যে প্রাথমিকভাবে শোনার, একালের মিডিয়া কালচার তা ভুলিয়ে দিতে পেরেছে। সব দেখিয়ে দিতে হবে। হাঁটু ছেঁড়া জিন্স পরে গায়ক সমুদ্রের ধারে। সেখানে প্রেমিকা সম্বোধিত হচ্ছেন ‘ তু্ই ‘ বিশেষণে। টুনির মা- তেও অনুযোগের একটা সরল কারণ ছিল, রিদম এ একটা নিরীক্ষা ছিল। এখনকার বাংলা সুফি বা পুরোনো দিনের কভার গানে যন্ত্রের এমন বেয়াদপ দাপাদাপি, যে শ্রোতা শোনার আগে পালিয়ে বাঁচার রাস্তা খোঁজেন। কান বাঁচাতে হবে আগে। তারপরে তো শোনা। গানের মাঝে, আগে পরে এসে যাবে বিজ্ঞাপন। কালের যাত্রায় রুচি, কারিগরি পাল্টায়। গেল শতকের চল্লিশের দশকে যে গান শুনেছি, আজ তা সঙ্গত কারণেই আসবে না। কিন্তু আজকের অফারিংস এ সময়ের সুর, সময়ের স্কিল্ড কথা থাকবে না? যত কৃতিত্ব আদায়ের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথের গানের সুরকে ধ্বস্ত করে। শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্তরা নতুন গানের পালে বাতাস আনার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু মিডিয়া তার সমাদর করছে কোথায়? আর রেডিও টিভি রেকর্ড ক্যাসেট– শোনার বস্তুগুলিও যে উধাও। ক দিন আগেই সোদপুরে গিয়ে শুনে এসেছি প্রচারবিমুখ গায়ক কাঞ্চন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা অপূর্ব আগমনী, আধুনিক। সে গান শোনানোর দায়িত্ব কে নেবেন? পুজোর গানের প্রচারে বড় ভূমিকা নিত পাড়ার জলসা। সে সব অনুষ্ঠানের রং ঢং বেড়েছে, কিন্তু নীরবে বেসিক বাংলা গানের বিদায় ঘটে গেছে। টিভির গানের প্রতিযোগিতাগুলি নতুন প্রতিভাদের সামনে আনছে বটে, কিন্তু সকলের গলাতেই শোনা যাচ্ছে হারানো দিনের হীরামানিক। পুজোর গান তো ছিল শিল্পীদের কণ্ঠে নব প্রত্যাশার হালখাতা। আবিষ্কারের সে আনন্দ পুজো আর পুজোর গান থেকে ক্রমশঃ মুছে গেছে।হারিয়ে গেছে পুজোর গান, গানের বৈভব।