হতে চেয়েছিলেন যশপ্রীত বুমরার মতো ফাস্ট বোলার। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্যাভলিনই হয়ে ওঠে শচীন যাদবের ধ্যানজ্ঞান। নিজের এই সিদ্ধান্ত বদল পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম খেকরা(Khekra)-র ৬ ফুট ৫ ইঞ্চির অ্যাথলিটকে। টোকিওর বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পর থেকে তাঁর নাম ঘুরছে মুখে মুখে। নীরজ চোপড়া, আরশাদ নাদিম, জুলিয়ান ওয়েবারদের মতো তারকাদের ছিটকে দিয়েছে তাঁর ৮৬.২৭ মিটারের থ্রো। মাত্র ৪০ সেন্টিমিটার ব্যবধানের জন্য হাতছাড়া হয়েছে ব্রোঞ্জ পদক।
১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের খেকরায় জন্ম শচীন যাদবের। শুরুর দিকে ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও ১৯ বছর বয়সে তিনি মন দেন জ্যাভলিনে। প্রতিবেশী অ্যাথলিট সন্দীপ যাদবই তাঁকে জ্যাভলিনে টেনে আনেন। সন্দীপের পরামর্শ ও ট্রেনিং নিয়ে দ্রুত নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন শচীন। শক্তপোক্ত শারীরিক কাঠামো তো ছিলই, এর সঙ্গে পেস বোলিং করার সুবাদে একরকম তৈরি ছিল শচীনের ডান হাত। সেটাকেই মাজাঘসা করে শৃঙ্খলায় বেঁধেছেন প্রথম কোচ সন্দীপ যাদব।
শক্তপোক্ত গড়নের জন্য জ্যাভলিন থ্রোয়ার শচীন যাদবকে প্রায়শই পাকিস্তানের আরশাদ নাদিমের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাছাড়া পাক থ্রোয়ার নাদিমও শচীনের মতোই শুরুতে ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। তুলনাটা তাই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। তবে প্যারিস অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী নাদিমের থেকে কিন্তু তিনি অনেকটাই পিছিয়ে। অন্তত থ্রো-এর দিক থেকে। এখন পর্যন্ত একবারও তিনি ৯০ মিটারের গণ্ডি টপকাতে পারেননি। বছর পঁচিশের অ্যাথলিট একবার সেটা পার করলেও ফাউলের জন্য সেই থ্রো বাতিল হয়েছিল।
শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত শচীন যাদবের মধ্যে আরও উন্নতি করার সম্ভবনা দেখেছেন জ্যাভলিন বিশেষজ্ঞরা। ক্রিকেট ছেড়ে জ্যাভলিনে এসে নিজেকে নিঁখুত করার চেষ্টা সবসময়ই চালিয়েছেন শচীন। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন খ্যাতনামা কোচ পেরুর মাইকেল মুসেলম্যানের সঙ্গে। ভার্চুয়ালি প্রশিক্ষণের টিপস চেয়েছেন মুসেলম্যানের কাছে। দেরিতে শুরু করলেও সে সময়ের ২১ বছর বয়সী শচীনকে তিনি নিরাশ করেননি। মুসেলম্যানের নির্দেশেই তাঁর ভারতীয় বন্ধু সমরজিৎ সিং বছর দুই ধরে শচীনকে গাইড করেছেন।
সমরজিৎ সিংয়ের অত্যাধুনিক ট্রেনিং-এ শচীন নিজের ৭৪ মিটারের থ্রোকে নিয়ে চলে আসেন ৮১ মিটার পর্যন্ত। এই সময় ওজন কমাতে যেমন বিশেষ ডায়েট করেছেন, তেমনি থ্রো-র পর পড়ে যাওয়ার সমস্যা কাটাতে ব্লক লেগ নিয়েও চলছে ঘসামাজা। প্রযুক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি আর্থিক সহয়তার দিকটাও মাথায় রাখতে হয়েছে মুসেলম্যানের ভারতীয় বন্ধু সমরজিৎকে।
ভারতীয় ছাত্রের এমন অগ্রগতিতে মুগ্ধ খ্যাতনামা কোচ মাইকেল মুসেলম্যান। সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, স্টেডিয়ামের দর্শকদের চাপের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারেন শচীন। টোকিওর বিশ্ব প্রতিযোগিতার আগে এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে সেটি প্রমাণ করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় আরশাদ নাদিমের পেছনে ৮৫.১৬ মিটার ছুড়ে রৌপ্যপদক জয় করেছেন। বড় আসরে শচীনের স্নায়ুর চাপ নিয়ন্ত্রণ করার গুণ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন মুসেলম্যান।
বর্তমানে নয়াদিল্লিতে বিখ্যাত কোচ নাভাল সিংয়ের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন শচীন যাদব। টোকিও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২৫ বছর বয়সী শচীন একবার নয়, তিনবার তাঁর ব্যক্তিগত সেরা পারফরমেন্স অতিক্রম করেছেন। টোকিওর আর্দ্র আবহাওয়ায় যেখানে বেশ কয়েকজন তারকা থ্রোয়ার ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে তিনি ৮৬.২৭ মিটারের থ্রো দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং তিনবার ৮৫ মিটার অতিক্রম করেছেন। মাত্র ৪০ সেন্টিমিটারের ব্যবধানে হারিয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক। ইউএসএ-র কার্টিস থম্পসন পেয়েছেন ব্রোঞ্জ।
টোকিওতে জ্যাভলিন ফাইনালে নীরজ চোপড়ার স্থান ছিল অষ্টম, পাকিস্তানের আরশাদ শাদিম দশম স্থানে শেষ করেছেন। আর শচীন যাদবের স্থান চতুর্থ। তবে যোগ্যতা অর্জন পর্বে নীরজের সঙ্গে একই গ্রুপে ছিলেন শচীন। প্রথম থ্রোতে মাত্র ৮০.১৬ মিটার ছুড়লেও শেষদিকে ৮৩.৬৭ মিটার জ্যাভলিন ছুড়ে দশম স্থানে থেকে ফাইনালের ১২ জনের মধ্যে জায়গা করে নেন।
”শচীনের মধ্যে অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সে শরীরের চর্বি বা শরীরের ভারের ১০ শতাংশ কমিয়ে ফেলে এবং পায়ের জোর বাড়ায়, তবে আমার মনে হয় তাঁর নাদিমের মতোই অলিম্পিক্সের আসরেও সেরা হওয়ার সম্ভাবনা আছে”। প্রাক্তন ছাত্রকে ঘিরে রীতিমতো আশাবাদী মুসেলম্যান।
তিনি আরও বলেন, “নাদিম অ্যাথলেটিক নয়, সে খুব শক্তিশালী নয়। কিন্তু, তাঁর সেরা ব্লক আছে, এবং তাঁর হাতের গতি অসাধারণ। এই কারণেই গত বছর ৯৩ মিটার থ্রো করতে পেরেছিল নাদিম। তাছাড়া বেশি ওজনও তুলতে পারে না। শুরুতে একজন ক্রিকেটার ছিল বলে। শচীনও দ্রুত বল করতে পারত। তাই নাদিমের সঙ্গে একটা তুলনা তো থেকেই যায়।”
মুসেলম্যানের বিশ্বাস, শচীন যদি নাদিমের মতো ব্লক এবং জুলিয়ান ওয়েবারের মতো অ্যাথলেটিসিজম একত্রিত করতে পারেন, তাহলে তিনি অচিরেই ৯৫ মিটারেরও বেশি জ্যাভলিন ছুড়ে ফেলতে পারবেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধারাবাহিকতা দেখাতে আর্থিক সঙ্গতি এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণের দিকটাও গুরুত্ব দিয়েছেন পেরুর খ্যাতনামা জ্যাভলিন কোচ।
মুসেলম্যানের এমন ভবিষ্যদ্বাণী যদি সত্যি হয়, তাহলে শচীন যাদবই জ্যাভলিনে এখন ভারতের সেরা বাজি। টোকিওর বিশ্ব প্রতিযোগিতার সাফল্য আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে দিতে পারবে বলেই মনে করছেন সবাই। সেটি বাস্তবায়িত হলে, ২০২৮-এর লস এঞ্জেলস অলিম্পিক্সে জ্যাভলিন থেকে ভারতে পদক আসা একরকম নিশ্চিত।