
এক হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর কটক, যা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত, শনিবার রাতের হিংসার পর এখন উত্তেজনায় ফুটছে। দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে বেরোনো এক শোভাযাত্রাকে ঘিরে দরগা বাজার এলাকায় শুরু হওয়া সংঘর্ষে শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
প্রশাসন ইতিমধ্যে ৩৬ ঘণ্টার কার্ফু জারি করেছে এবং রবিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে, যাতে ভুয়ো খবর বা উস্কানিমূলক বার্তা ছড়িয়ে না পড়ে।
শুক্রবার গভীর রাতে, দরগা বাজার দিয়ে কাথাজোড়ি নদীর দিকে যাচ্ছিল দুর্গা বিসর্জনের শোভাযাত্রা। রাত দেড়টা নাগাদ উচ্চস্বরে বাজনা বাজানো নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ছাদ থেকে ইট-পাথর ও বোতল ছোঁড়া হয়, পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরাও উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
এই ঘটনায় কটকের ডিসিপি সহ একাধিক ব্যক্তি আহত হন। গুরুতর আহত এক ব্যক্তিকে ভর্তি করা হয়েছে এসসিবি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে এবং ঘটনাস্থল থেকে ছয়জনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ কমিশনার এস দেবদত্ত সিংহ জানিয়েছেন, সিসিটিভি ও ড্রোন ফুটেজের মাধ্যমে দুষ্কৃতীদের শনাক্তের কাজ চলছে এবং আরও গ্রেফতার হবে।

রবিবার সন্ধ্যায় আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মোটরবাইক র্যালি বের করে। মিছিলটি বিদ্যাধরপুর থেকে শুরু হয়ে দরগা বাজার পার হয়ে সিডিএ সেক্টর ১১ পর্যন্ত পৌঁছায়, যা আগের সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এই সময় গৌরীশঙ্কর পার্ক এলাকায় একাধিক দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, এবং কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন কটক পুরসভা ও সংলগ্ন অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছে। শহরের সংবেদনশীল এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং কারফিউ জারি করে গণজমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি, যিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বেও আছেন, এক বিবৃতিতে বলেন, “কটক ঐক্য ও সম্প্রীতির শহর। কিছু দুষ্কৃতীর কারণে শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। সরকার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি এবং প্রশাসনকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেডি সভাপতি নবীন পট্টনায়ক প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বলেন, “কটক, যা ভ্রাতৃত্বের শহর হিসেবে পরিচিত, সেখানে এমন হিংসার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিজেপি সরকারের চাপে পুলিশ সম্পূর্ণ অসহায়।”
অন্যদিকে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রশাসনিক ত্রুটির অভিযোগ তুলে সোমবার ১২ ঘণ্টার বন্ধ-এর ডাক দিয়েছে। পাশাপাশি তারা ডিসিপি ও জেলা শাসকের বদলি দাবি করেছে। কংগ্রেস বিধায়ক সোফিয়া ফিরদৌস বলেছেন, “কটক শতাব্দী প্রাচীন ঐক্যের প্রতীক। যারা সম্প্রীতি ভাঙার চেষ্টা করছে, তাদের কঠোর আইনি শাস্তি হওয়া উচিত।”
ডিজিপি ওয়াই.বি.খুরানিয়া রবিবার রাতে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীও নিয়মিত আপডেট নিচ্ছেন বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে জানা গেছে।

শনিবার রাতের হিংসার পর স্থগিত থাকা বিসর্জন রবিবার সকালে পুনরায় শুরু হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ১২০টি প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে শহরজুড়ে টহলদারি জারি রয়েছে, এবং প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে। তবে পরিস্থিতি এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলেই সূত্রের খবর।