
ঢাকার পুঁজিবাজারের অন্ধকার গলিতে এক নাম আজও আতঙ্কের প্রতীক গ্যাম্বলার মিজান ওরফে মোঃ সাঈফ উল্লাহ। জন্ম লামচর ইউনিয়নের রামগঞ্জে, আর আজ তার নাম জড়িয়ে আছে দেশের আর্থিক প্রতারণা, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর ইতিহাসে।
১৯৯০-এর দশকে ধর্ষণ, হত্যা ও ডাকাতির মামলায় নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে আসে সে। মতিঝিলের একটি কলোনিতে পিয়নের চাকরি নিয়ে খাজা সিকিউরিটিজে শুরু হয় তার ভাগ্য বদলের গল্প। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে এক ধাপ্পাবাজ বিনিয়োগকারীর গুরু, যিনি মানুষের স্বপ্নের টাকা দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতারণার দুর্গ।
১৯৯৫ সালে সার কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়ে উত্তরবঙ্গের কৃষকদের রক্ত ঝরানোর পেছনে উঠে আসে তার সিন্ডিকেটের নাম। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ১৬ টাকার সার ১৬০ টাকায় বিক্রি করে সে। এই কেলেঙ্কারিই বি এন পি সরকারের পতনের অন্যতম কারণ হয়। সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পালিয়ে যায় মিজান, কিন্তু কখনো ধরা পড়ে না।
এরপর ১৯৯৬ সালে ফিরে আসে শেয়ারবাজারে। কাগজের শেয়ার নকল করে বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্ব লুটে নেয়। সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোটি টাকার প্রতারণার দায়েও সাজাপ্রাপ্ত হয়, তবুও গা ঢাকা দেয়। বছরের পর বছর পলাতক থেকেও, সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে টিকে যায় এই ধূর্ত।
২০২০ সালে আবারও ফিরে আসে ঢাকায়। বনশ্রীতে ভাড়া বাসা নিয়ে পুরনো সিন্ডিকেটকে সক্রিয় করে তোলে। করোনাকালীন অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাকে পুঁজি করে শুরু করে নতুন খেলা। ‘১ মাসে দ্বিগুণ মুনাফা’ এই প্রলোভনে সাধারণ মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলে লুটে নেয় কোটি কোটি টাকা। সঙ্গে যোগ দেয় তার ছোট ভাই গ্যাম্বলার এ জি মাহমুদ।
মাহমুদ, যিনি ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত হয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসে, মিজানের সহযোগী হয়ে গড়ে তোলে ভয়ংকর প্রতারণার নেটওয়ার্ক। বড় বিনিয়োগকারীদের কলগার্লের সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করা থেকে শুরু করে, কম দামে শেয়ার কিনে উচ্চ দামে সাধারণ মানুষকে ধরিয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত করা সবই এই ভাইদের ব্যবসার কৌশল।
এদিকে তৃতীয় ভাই ফয়জুল্লাহ জিসান, সাবেক চেয়ারম্যান ও কালা তাহের বাহিনীর সদস্য, হয়ে ওঠে জমি দখল আর অস্ত্রের রাজনীতির নতুন মুখ। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় জমি দখল, গরিবের জমি কেড়ে নেওয়া, ভয় দেখানো। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পতনের পর সে পলাতক, এখন দুই ভাইয়ের ছত্রছায়ায় লুকিয়ে আছে।
২০২১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই দুই ভাইয়ের নামে একাধিক জরিমানা ঘোষণা করলেও কার্যত কিছুই করতে পারেনি। মিজান-ভাইদের সিন্ডিকেট চোখ রাঙিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মতিঝিল, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পথে বসে গেছে।
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, মুন্নু সিরামিক, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, জি বি বি পাওয়ার, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড, ফরচুন সুজ, লাভেলো, প্রভাতি ইন্স্যুরেন্স এসব কোম্পানির শেয়ারেই ধ্বংস হয়েছে হাজারো বিনিয়োগকারীর জীবন।
গ্যাম্বলার মিজানের ধূর্ত বুদ্ধিতে দুই সরকারের পতন, হাজার মানুষের সর্বনাশ তবু আইন যেন আজও অন্ধ। পুঁজিবাজারে তার ছায়া ঘোরে আজও, নতুন প্রলোভনের রঙে রাঙানো ফাঁদ নিয়ে।
