
মৌমিতা চ্যাটার্জি
তিন বছর তিন মাস উনিশ দিন পর অবশেষে জেলের অন্ধকার পেরিয়ে বাড়ি ফিরলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সি জেলে দীর্ঘ বন্দিদশার পর বুধবার সকালে তাঁর নাকতলার বাড়িতে ফিরে আসার মুহূর্তে ছিল নিস্তব্ধতা, কৌতূহল আর প্রশ্নের ভার। একসময় তৃণমূলের অন্যতম মুখ, যাঁর চারপাশে একসময় ভিড় জমাত রাজনীতির আলোচনায় আজ তাঁর প্রত্যাবর্তন যেন অনেকের মনে নতুন তরঙ্গ তুলেছে।
বাড়িতে প্রবেশের পর থেকেই দেখা গেছে পারিবারিক উষ্ণতার ছোঁয়া। দীর্ঘদিন পর নিজের ঘরে ফিরে যেন খানিক স্থবির হয়ে গিয়েছেন পার্থ। নিকটজনদের সঙ্গে নিরব সাক্ষাতে কেটেছে সকালটা। প্রেসিডেন্সি জেলে থাকা কালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সেই সময় চিকিৎসক ও নার্সদের তৎপরতায় তিনি সুস্থ হন। তাঁর ভাই অমলের অক্লান্ত পরিশ্রম, আইনি লড়াই সব মিলিয়ে পরিবারই যেন হয়ে উঠেছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি।
বাড়ি ফিরে রাজনীতি নিয়ে মুখ খুললেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী। ফোন না থাকায় দলের কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি, তবে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে তৃণমূল সুপ্রিমোর কাছে চিঠি পাঠানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই কিছু স্পষ্ট না করলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রয়োজনে বিধানসভায় যাবেন কিন্তু হাত তোলার জন্য নয়, বেহালা পশ্চিমের মানুষের কথা বলতেই।
দীর্ঘ জেলজীবনের পরও রাজ্যের প্রশাসনিক নানা খুঁটিনাটি বিষয় তাঁর মনে রয়ে গেছে। পুলিশ ও জেলকর্মীদের পুরনো ছুটির নিয়ম পরিবর্তন নিয়ে ক্ষোভের কথা তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাবেন বলেও জানান তিনি। পার্থর কথায়, যারা সারাদিন পরিশ্রম করে তাদের প্রাপ্য সুযোগ কেড়ে নেওয়া উচিত নয়।
অন্যদিকে, দুর্নীতি মামলা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিতর্কে নাম জড়ানোর প্রসঙ্গেও আত্মপক্ষ সমর্থনে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন প্রাক্তন মন্ত্রী। তাঁর মতে, অভিযোগের কালিমা আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক ফাঁদ, যেখানে চরিত্রহননই মূল উদ্দেশ্য। তবে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর বাড়তি কোনও মন্তব্য না করেই তিনি যেন একপ্রকার নীরব প্রতিবাদে নিজেকে স্থির রাখলেন।
তিন বছরের বন্দিদশার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠেছে ক্লান্তি ও বেদনার মিশেল। জানালেন, জেলের জীবন এমন এক বাস্তব, যা কারোরই জীবনে আসুক চান না। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, সময়ই তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করবে।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অবস্থান এখনো দ্ব্যর্থহীন নয়। তিনি দাবি করেছেন, দলের তরফে কোনো লিখিত বরখাস্তের চিঠি পাননি। তাই এখনই ‘সাসপেন্ডেড’ বলা যায় না। তাঁর কথায়, তিনি দলের একনিষ্ঠ কর্মী, দলের বিপক্ষে কখনও কোনো কাজ করেননি। তৃণমূলের ভিতরে যে আজ অনেকেই “দ্বিতীয় ইনিংস” খেলছেন, তা মনে করিয়ে দিয়ে পার্থ যেন ইঙ্গিত করলেন সুযোগ পেলে তিনিও পিছিয়ে থাকবেন না।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বেহালা পশ্চিমে ঘরে ঘরে যাবেন কি না সেই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব, তিনি ভোট চাইতে নয়, মানুষের কাছে নিজের জবাব দিতে যাবেন। তাঁর বিশ্বাস, এলাকার মানুষ তাঁকে প্রশ্ন করবেন, আর তিনি বুক চিতিয়ে নিজের সততার প্রমাণ দেবেন।
তবে রাজনীতির এই নতুন অধ্যায়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। পার্থ জানিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ডাকলে তিনি নিশ্চয়ই দেখা করবেন। সেই এক বাক্য যেন তাঁর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছে সম্পর্কের সেতুটি এখনো পুরোপুরি ভাঙেনি।
নাকতলার বাড়িতে এখন কিছুটা স্বস্তির হাওয়া, কিছুটা নীরব কৌতূহল। তিন বছর আগের ঝড়ো সময় থেকে বেরিয়ে আসা এক মানুষ আবার নিজের ঘরে ফিরেছেন। কিন্তু রাজনীতি কি তাঁকে আবার ফিরিয়ে নেবে? উত্তর হয়তো সময়ই দেবে তবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রত্যাবর্তনে বাংলার রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে নতুন জল্পনা শুরু হয়েছে।

