
নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত
বিহারের রাজনীতির মঞ্চে এমন এক চরিত্র আছেন, যিনি বারবার ধ্বংসস্তুপের ভিতর থেকেও নিজের পথ বানিয়ে বেরিয়ে আসেন। যেন শুকনো জঙ্গলে আচমকা ফিরে-আসা বুনো বাঘ শান্ত, নিঃশব্দ, অথচ ভয়ংকরভাবে দৃশ্যমান। তিনি নীতিশ কুমার। ২০২৫-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে আবারও সেই বাঘের ডাকে দুলতে শুরু করেছে বিহারের রাজনৈতিক বনভূমি ‘টাইগার আভি জিন্দা হ্যায়’।
নীতিশকে শুধু জেডিইউ-র নেতা বলা ভুল হবে। তিনি এক রাজনৈতিক প্রকল্প যেখানে আদর্শ, বাস্তবতা, জোটের গণিত এবং ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা মিলেমিশে তৈরি হয় এক অদ্ভুত রাসায়নিক সংযোগ। সুশাসনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে তাঁর পরিচিতি সারা দেশের। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেক্ষাপট বদলেছে, চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। ২০২৫-এর নির্বাচনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক বহুমাত্রিক সংকট ও সুযোগের মোচড়ে।
এনডিএ জোটে সমান আসন ভাগাভাগির হিসাব আপাতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ মনে হলেও বাস্তবে তা ভীষণ সূক্ষ্ম। বিজেপি-র শক্তিবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নীতিশের ওজন কেমন থাকে এটাই এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষণদের প্রধান কৌতূহল। জোটের ভেতরে নীতিশের অভিজ্ঞতা এবং আপসহীন সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা তাঁকে এখনও অপরিহার্য করে রেখেছে। কিন্তু বিজেপি কি তাঁকে সমান অংশীদার হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে মেনে নেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মঞ্চের সামনে হাসিমুখে করমর্দন হলেও, অন্তরালের দড়ি-টানাটানি স্পষ্ট।
এই রাজনৈতিক সমীকরণের মাঝেই নীতিশ আবার থলে থেকে বের করছেন তাঁর পুরনো অস্ত্র উন্নয়ন। যুবকদের জন্য স্কিল ফান্ড, নারী সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রকল্প, প্রবীণদের জন্য ভাতা এসবের বরাদ্দ বাজেটে নতুন করে জোর দেওয়া হয়েছে। বিহারের বাস্তব রাজনীতিতে উন্নয়ন কেবল নীতিগত কথা নয়, নির্বাচনী মুদ্রা। এবং এই মুদ্রার দাম ঠিক কত, তা নীতিশ কুমার খুব ভালো করেই জানেন।
তবে সব পথ এত সহজ নয়। আরজেডি-র আক্রমণ এবার আরও ধারালো নীতিশকে তাঁরা দিশাহীন, প্রভাবহীন এবং ‘হাইজ্যাকড’ নেতা বলে আখ্যা দিচ্ছেন। টার্গেট স্পষ্ট: নীতিশকে আঘাত করো, জোটকে দুর্বল করো। অন্যদিকে কংগ্রেসও চাইছে নিজস্ব জনভিত্তি পুনরুদ্ধার করতে। ফলে নীতিশের চারদিকে তৈরি হয়েছে এক রাজনৈতিক মাইনফিল্ড; কোথায় পা পড়লে বিস্ফোরণ হবে বলা কঠিন।
এছাড়া নীতিশের বয়স এবং নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়েও নানাভাবে প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য তিনি কি আর দীর্ঘ দৌড়ের প্রস্তুতিতে আছেন? জোটসঙ্গীরা কি তাঁকে ভবিষ্যতের মুখ হিসেবে দেখবে, নাকি শুধু ‘ট্রানজিশনাল লিডার’ হিসেবে ব্যবহার করবে? এসব প্রশ্ন নীতিশকে আঘাত করছে কিনা বোঝা কঠিন কিন্তু তিনি আপাতভাবে সাংঘাতিক স্থির। যেন জঙ্গলের মাঝখানে বসে থাকা সেই বয়স্ক বাঘ, যার দৃষ্টিমাত্রই শিকারকে জমাট বেঁধে ফেলে।
নীতিশের এই নতুন রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ কতটা টেকসই? জোট কি তাঁর নেতৃত্বে আরেক দফা স্থিতিশীল সরকার গড়তে পারবে, নাকি পশ্চাদপসরণ করবে? এবং সবশেষে, বিহারের ভোটাররা কি এখনও বিশ্বাস করেন সুশাসন বাবুর সেই বাঘ-গর্জন সত্যিই আগের মতো প্রবল?
ইতিহাস বলে, নীতিশকে খেলার বাইরে ফেলা সহজ নয়। তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথ এমনই কখনও জোট বদল, কখনও মতাদর্শের রদবদল, কখনও চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন। কিন্তু প্রতিবার তিনি নিজের ছন্দে ফিরে এসেছেন। হয়তো এই কারণেই আজও বিহারের রাজনৈতিক বনে একটি কথা গড়ে ওঠে ‘টাইগার আভি জিন্দা হ্যায়’।
আগামী নির্বাচনই বলবে এই বাঘের গর্জন কতটা মূল্যবান, আর কতটা প্রতীকী। কিন্তু একটি কথা নিশ্চিত নীতিশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক তরঙ্গ থামার নয়। তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হবে জোটের গতিপথ, বদলাবে বিরোধীর কৌশল, এবং সবচেয়ে বড় কথা, নির্ধারিত হবে বিহারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
