
নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত
বিহারের রাজনীতিতে আজ যে দৃশ্য ফুটে উঠল, তা যেন এক কঠিন কিন্তু স্পষ্ট বার্তা প্রশান্ত কিশোর যতই নিজেকে ‘রাজনৈতিক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’ ভাবুন না কেন, ভোট বাক্সে মানুষ তাকে এক মুহূর্তও গুরুত্ব দিতে চাইলো না। ‘নতুন রাজনীতি’, ‘নতুন দিশা’, ‘গ্রাম-পরিক্রমা’ এ সব বড় বড় শব্দগুলো আজ বিহারের বাতাসে ধুলো হয়ে উড়ে গেল। গণতন্ত্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভোটাররা দেখিয়ে দিলেন, স্ট্র্যাটেজিস্ট হওয়া আর নেতা হওয়া এ দুটো আকাশ-পাতাল আলাদা জিনিস।
সকাল থেকে ট্রেন্ড শুরু হওয়ার পরই যে দৃশ্য সামনে আসে, তা এক কথায় লজ্জাদায়ক। জন সুরাজ কোথাও নেই একেবারে নেই। একটি আসনেও এগিয়ে নেই, এমনকি সামান্য আলোড়ন তোলার ক্ষমতাও দেখা গেল না। অন্যদিকে এনডিএ একের পর এক আসন দখল করছে, মহাগঠবন্ধনও কিছুটা লড়াই দিচ্ছে আর কিশোরের দল সেই বিশাল পরিসরে এক বালির দানার মতো হারিয়ে রয়েছে।
প্রশান্ত কিশোর অন্য দলকে জেতানোর স্ট্র্যাটেজি দিয়ে দেশজোড়া নাম কামিয়েছেন, কিন্তু নিজের দলের ক্ষেত্রে সেই স্ট্র্যাটেজি কেন কাজ করল না? কারণ খুব সহজ, তিনি ভেবেছিলেন, নিজের খ্যাতি, বিতর্কিত বড় বড় মন্তব্য আর কিছু বিশ্লেষণ দিলেই মানুষ তার দলে ছুটে আসবে। মানুষকে যেন তিনি ‘গণিতের সমীকরণ’ হিসেবে ধরেছিলেন মানুষ যে আবেগ, অভিজ্ঞতা ও আস্থার ওপর ভোট দেয়, সেটা তিনি বুঝতেই চাননি।
জেডিইউ ২৫ ছাড়ালেই রাজনীতি ছাড়বেন, এমন বক্তব্য আগেই দিয়েছিলেন। আর এবারের নির্বাচনে জেডিইউ পেরিয়ে গেল ৭৫–এর কাছাকাছি! অর্থাৎ ভবিষ্যদ্বাণীতে তিনি যে কত দূরে তা যেন ভোটাররা ব্যঙ্গ করে দেখিয়ে দিলেন। নিজের পূর্বাভাসের ওপরে কিশোরের যে অহংকার ছিল, তা আজ যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
আরেকটা স্পষ্ট ছবি বেরিয়ে এসেছে প্রশান্ত কিশোরের রাজনীতি ‘গ্রাউন্ড লেভেল’ দিয়ে তৈরি নয়, বরং তিনি ভেবেছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়া আলোড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য, আর কিছু মিডিয়ার আলোচনাই মানুষকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু বিহারের ভোটাররা কঠিনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন: রাজনীতি নিতান্তই মাটির খেলা, হাওয়ায় ঝুলে থাকা তত্ত্ব দিয়ে এটি হয় না।
এই নির্বাচনে দেখল সবাই হাজারো গ্রাম ঘোরা, পায়ে হাঁটা অভিযান, স্লোগান তৈরির নাটক এসবই কাগজে-কলমে যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবে ভোটে ততটাই অকার্যকর। মানুষ তাকে বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি। কারণ তিনি মানুষের কথা শোনার চাইতে নিজের কথাই বেশি প্রচার করেছেন। নেতা হতে গেলে যে বিনয় লাগে, মানুষের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মানসিকতা লাগে সেটা তার মধ্যে স্পষ্ট অনুপস্থিত।
আজকের ফলাফলে আরও একটা বড় ইঙ্গিত উঠে এসেছে বিহারের রাজনীতিতে একটা ‘বাইরের বুদ্ধিজীবী’ এসে নৈতিকতার পাঠ পড়ালে মানুষ বিরক্ত হয়। প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্যের ধরণেই ছিল যেন এক ধরনের ঔদ্ধত্য যেন তিনিই নতুন আলোর পথ দেখাবেন। অথচ বাস্তব হল, মাটির মানুষ তার ভাষা বুঝলই না, বরং তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই ক্ষোভ তৈরি করল।
সবশেষে ফলাফল দাঁড়াল এনডিএ-র দাপুটে জয়, মহাগঠবন্ধনের সীমিত লড়াই, আর প্রশান্ত কিশোরের রাজনৈতিক সেট-আপ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া। জন সুরাজ আজ বিহারের রাজনীতিতে শুধু একটি শূন্য নয়; এটি কিশোরের অহংকার ভাঙার প্রতীক, তার রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার প্রকট প্রমাণ, এবং তাঁর ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট-থেকে-নেতা’ রূপান্তরের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
প্রশান্ত কিশোর হয়তো আবার বিশ্লেষণ করবেন, আবার সংখ্যার হিসাব দেবেন কিন্তু আজ বিহার দেখিয়ে দিল, গণতন্ত্রে নেতা হওয়ার জন্য শুধু মাথা নয়, মানুষের মন লাগে, আর সেটাই তার সবচেয়ে বড় ঘাটতি।
