পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার মেয়র এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা ফিরহাদ হাকিম সম্প্রতি একটি মন্তব্য করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন। তার বক্তব্য, যেখানে তিনি দাবি করেছেন যে মুসলিমরা একদিন “সংখ্যাগরিষ্ঠের চেয়ে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ” হয়ে উঠতে পারে, তা দেশজুড়ে বিস্তর আলোচনা এবং বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। হাকিমের এই মন্তব্যকে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার “বিশুদ্ধ বিষ” বলে অভিহিত করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে এটি একটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উসকানি।
কলকাতায় এক শিক্ষা অনুষ্ঠানে, যেখানে তিনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন, হাকিম বলেছিলেন, “আমরা এমন একটি সম্প্রদায় থেকে এসেছি যেটি বাংলার জনসংখ্যার 33 শতাংশ, ভারতে 17 শতাংশ এবং আমাদেরকে সংখ্যালঘু বলা হয়। কিন্তু আমরা নিজেদেরকে সংখ্যালঘু মনে করি না। যদি আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেন, আমরা একদিন সংখ্যাগরিষ্ঠের থেকেও বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠব।” তার এই মন্তব্যে তিনি শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের শক্তি এবং ঐক্যের কথা বলেননি, বরং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্যও রেখেছেন।
হাকিমের এই মন্তব্যের পরে বিজেপি নেতারা তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সুকান্ত মজুমদার, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি, এই বক্তব্যকে “বিশুদ্ধ বিষ” বলে চিহ্নিত করেছেন এবং হাকিমকে “প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার এবং একটি বিপজ্জনক এজেন্ডা ঠেলে দেওয়ার” জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তার মতে, এটি একটি “বাংলাদেশ-ধরনের পরিস্থিতি তৈরির একটি নীলনকশা” এবং ভারতীয় সমাজের ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্য হুমকি।
এছাড়া বিজেপির আইটি ইনচার্জ অমিত মালভিয়া মন্তব্য করেছেন, “হাকিম এমন একটি ভবিষ্যতের কথা বলেছেন যেখানে মুসলমানরা আর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ বা মিছিলের উপর নির্ভর করবে না, বরং তারা নিজের হাতে ন্যায়বিচার নেবে, যা সম্ভবত শরিয়া আইনের ইঙ্গিত দেয়।” তিনি আরও বলেন, হাকিমের এই মন্তব্য অবৈধ অভিবাসীদের প্রবাহকে উৎসাহিত করবে এবং জনসংখ্যার ভারসাম্যকে অস্থিতিশীল করবে।
হাকিমের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে এই মন্তব্য নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে, এবং অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে এই ধরনের বক্তব্য সাম্প্রদায়িক অশান্তি এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে কলকাতার বস্তি এলাকায়, যেখানে রোহিঙ্গা সহ অবৈধ অভিবাসীরা একটি বড় অংশ, এই ধরনের মন্তব্য জনসংখ্যার ভারসাম্যকে আরো অস্থিতিশীল করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
তবে, ফিরহাদ হাকিমের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য যে কিছুটা বিভ্রান্তিকর, তা বলা যায়। তার মন্তব্যে মুসলিমদের জন্য একটি শক্তিশালী ভবিষ্যতের কথা বলা হলেও, তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং মুসলিমদের নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। যদিও তার বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা রাজনৈতিক আশঙ্কাও রয়েছে, তবুও এটি বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে একটি আশাবাদী দৃষ্টিকোণ নিয়ে আসে।
এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্যের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রীর এই নীরবতা ভবিষ্যতে দলের জন্য একটি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তার দলীয় নেতা এমন মন্তব্য করলে দলের নেত্রী কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তিনি এই ধরনের বক্তব্যকে সমর্থন করেন, তবে তা তৃণমূল কংগ্রেসের ভাবমূর্তি ও নির্বাচনী সমর্থনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্যের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে। বিশেষত, বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলমান। হাকিমের মন্তব্য যদি দলীয় স্তরে একটি বিভাজন সৃষ্টি করে, তবে তা আগামী নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে, মুসলিম সমাজের মধ্যে যদি এই মন্তব্যের প্রতি সাড়া পাওয়া যায়, তবে তা আগামী দিনগুলোতে রাজ্যের রাজনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অতএব, ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্যকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে দেখা উচিত নয়। এটি একটি গভীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকেত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ এবং রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আকারে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।