রাজনৈতিক শৃঙ্খলার অঙ্গীকারে একত্রিত হওয়া একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, কিছু দিনেই নিজের শৃঙ্খলা হারালো। তৃণমূলের বিধায়কদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তৈরি করা এই গ্রুপ, এখন নিয়ম ভঙ্গকারী, আত্মপ্রচারে মত্ত কিছু বিধায়কের জন্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় তৎপর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিধায়কদের নিজেদের পোস্ট করার ‘খেল’ অদ্ভুত এক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে, যা দ্রুত মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
অরূপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের লক্ষ্য ছিল পরিষদীয় দলের মধ্যে নিয়মিত নির্দেশাবলী পৌঁছে দেওয়া এবং দলের ঐক্য রক্ষা করা। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, অনেক বিধায়ক এই প্ল্যাটফর্মটিকে নিজের রাজনৈতিক উপস্থিতি বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচির ছবি, বক্তব্য, এবং এমনকি দৈনিক ‘গুড মর্নিং’ ও ‘গুড নাইট’-এর ছবি পোস্ট করতে গিয়ে তারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে।
প্রথমে বিষয়টি মেনে নেওয়া হলেও, শীর্ষ নেতাদের নজরে আসে এই কার্যকলাপ এবং তারপরই কড়া বার্তা দেওয়া হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি শুধুমাত্র দলের নির্দেশাবলী গ্রহণ ও প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করা হবে, সেখানে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রচারের জন্য কোনো পোস্ট করা যাবে না। কিন্তু, তৃণমূল বিধায়কদের একটি বড় অংশ নিজেদের খুশিমতো ছবি ও পোস্ট শেয়ার করতে থাকেন, যার ফলে দলের একাংশে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তৈরি হওয়া এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি মেম্বার্স’। যেখানে মোট ২১৬ জন তৃণমূল বিধায়ক ছাড়াও, বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া ছয় বিধায়কও যুক্ত হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শীতকালীন অধিবেশনে এক সভায় বিধায়কদের উদ্দেশে দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “কেউ দলের শৃঙ্খলার উর্ধ্বে নন। দলবিরোধী কাজ করলে শো-কজ হতে হবে এবং তিনবার শো-কজ হলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।”
অরূপ বিশ্বাস, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিমের সমন্বয়ে এই গ্রুপের দেখভাল করা হচ্ছে। তবে, বিধায়কদের নিজেদের মতো করে পোস্ট করার বিষয়টি একসময় চোখে পড়লে, তারা জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিধায়কদের কড়া বার্তা পাঠান। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শুধু দলের নির্দেশ ও তা গ্রহণের বিষয়েই আলোচনা হবে, ব্যক্তিগত বিষয়াদি এবং আত্মপ্রচার বন্ধ রাখতে হবে।
এ বিষয়ে এক প্রবীণ তৃণমূল নেতা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে উদ্দেশ্যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছিলেন, সে উদ্দেশ্যেই চলা উচিত ছিল। বিধায়কদের তাদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কার্যক্রম এই প্ল্যাটফর্মে শেয়ার না করে দলের নির্দেশ মেনে চলতে হবে।” দলের শীর্ষ নেতাদের এ নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার পর, দলের তরফে বিধায়কদের বলা হয়েছে, কোনো ধরনের ‘অবাঞ্ছিত’ পোস্ট করা যাবে না।
রাজনীতির মঞ্চে এমন ব্যক্তিগত প্রচারের প্রবণতা কেবল দলের ঐক্যকেই হুমকির মুখে ফেলে না, তা দলের শৃঙ্খলাকেও অটুট রাখতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে একজন দলীয় নেতা বা বিধায়ক তার কর্মসূচি বা বক্তৃতা শেয়ার করতে পারেন, সেখানে এ ধরনের আত্মপ্রচার তার নেতার চরম বিরুদ্ধতায় পরিণত হয়। দলের একাংশের ধারণা, এটি দলের কর্মসূচি এবং ভাবনাকে কলঙ্কিত করার পন্থা হতে পারে।
তবে সবকিছু মিলিয়ে, এই ঘটনায় তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কঠোর মনোভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দলের এই শৃঙ্খলা নির্ভরতা আরও শক্তিশালী করতে হবে, তা না হলে ভবিষ্যতে দলের ঐক্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এই বিরোধ ও বিভাজন হয়তো কিছুদিনের জন্য থামবে, কিন্তু এর সুরাহা না হলে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সংকট বাড়তে থাকবে। দলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের কাছে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।