নন্দীগ্রামে তৃণমূল কর্মী মহাদেব বিষয়ীর দেহ উদ্ধারের পরের ২৪ ঘণ্টা যেন এক বিস্ময়কর রাজনৈতিক নাটকের মঞ্চ হয়ে উঠল। ওই ঘটনায় তৃণমূলের তরফে সরাসরি বিজেপিকে দায়ী করা হলেও, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে নন্দীগ্রাম থানার আইসি অনুপম মণ্ডলের হঠাৎ বদলির নির্দেশ। জেলা পুলিশ সুপারের তরফে এই সিদ্ধান্ত রুটিন বদলি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও, বাস্তবে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
গত ২৫ ডিসেম্বর সকালে বৃন্দাবনচক গ্রামে মহাদেব বিষয়ীর দেহ উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি কর্মীরাই এই খুনের জন্য দায়ী। ঘটনায় ৩৯ জন বিজেপি কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৃণমূলের ক্ষোভের আগুন আরও জ্বলে ওঠে যখন জানা যায়, মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধানে নন্দীগ্রামে আরও এক তৃণমূল কর্মী বিষ্ণুপদ মণ্ডলকে খুন হতে হয়েছে।
তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে অভিযোগ, নন্দীগ্রামে শাসক দলের কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন প্রশাসন। আইসি অনুপম মণ্ডলকে এ জন্য সরাসরি দায়ী করা হয়। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই চাপ থেকেই তাঁকে রুটিন বদলির নামে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নন্দীগ্রামে আইসি বদলির ঘটনাটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর পেছনে দলীয় অভ্যন্তরীণ সংকটের ছবিও ফুটে উঠেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হার তৃণমূলের জন্য বড় আঘাত ছিল। শুভেন্দু অধিকারীর এই দুর্গে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে শাসকদল স্থানীয় নেতৃত্বের ওপর নির্ভর না করে বহিরাগত নেতাদের ওপর বেশি ভরসা করেছে।
কুণাল ঘোষ, দেবাংশু ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু বসু, দোলা সেনদের মতো নেতাদের নন্দীগ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হলেও, স্থানীয় কর্মীদের একাংশ তাঁদের নেতৃত্বে কাজ করতে আপত্তি জানিয়েছে। দলীয় কর্মীদের মধ্যে ভেতরের এই টানাপোড়েন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
নন্দীগ্রামে বিজেপির ক্রমবর্ধমান প্রভাব তৃণমূলের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিজেপির দাপটে তৃণমূলের অনেক কর্মী এলাকায় কাজ করার সাহস পাচ্ছেন না। ফলস্বরূপ, তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভীতি কাজ করছে। মহাদেব বিষয়ীর হত্যাকাণ্ড এই উত্তেজনার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।
স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ায় বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না শাসকদল। এর ফলে আইসি অনুপম মণ্ডলের বদলির মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্তরে এর ফলাফল নিয়ে নানা মত উঠে আসছে।
তৃণমূলের দাবি, প্রশাসনিক পরিবর্তন মূলত দলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে এবং কর্মীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে। তবে রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ ভিন্ন। তাঁদের মতে, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেরাই বুঝতে পারছেন যে, সংগঠনের ভেতরে যে ভাঙন শুরু হয়েছে, তা শুধুমাত্র প্রশাসনিক বদলির মাধ্যমে ঠেকানো সম্ভব নয়।
পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বদলিকে “রুটিন” বলা হলেও, সময় এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে সন্দেহের জায়গা থেকেই যাচ্ছে। মহাদেব বিষয়ীর হত্যার ঘটনার তদন্ত এখনও চলছে, এর মধ্যেই আইসি বদলি হয়ে যাওয়া প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তৈরি করছে।
নন্দীগ্রামের ঘটনা একদিকে প্রশাসনিক ব্যর্থতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ সংকটকে সামনে নিয়ে আসছে। একসময় নন্দীগ্রামে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি ছিল, কিন্তু আজ সেই অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে।
তৃণমূলের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ, কীভাবে দলীয় কর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনা এবং স্থানীয় স্তরে সংগঠনকে শক্তিশালী করা যায়। বহিরাগত নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে না পারলে, আগামী দিনে নন্দীগ্রামে তৃণমূলের পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
নন্দীগ্রামের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট শুধুমাত্র একটি জেলার প্রশাসনিক পরিবর্তনের সীমারেখায় আটকে নেই। এটি রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তৃণমূলের সামনে এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, সংগঠনের ভেতরের ফাঁকফোকর পূরণ করা এবং কর্মীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। অন্যথায়, নন্দীগ্রামের ঘটনাগুলি শাসকদলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক যাত্রাপথে আরও কঠিন বাধার জন্ম দিতে পারে।