আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই…। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরে যে অমলিন ভালোবাসার সুর, তা আজও বাঙালির হৃদয়ে অনুরণিত হয়। কিন্তু বাংলা গানের এই পথপ্রদর্শক আজ আর নেই। শনিবার ভোরে দীর্ঘ রোগভোগের পর অচেনা সাগরে ডিঙ্গা ভাসালেন এই গুণী শিল্পী। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় শুধুমাত্র একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা গানের এক বিপ্লবী। তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠত সমাজের কথা, সাধারণ মানুষের বঞ্চনার কথা, সংগ্রামের কথা। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শুধু একটি গান নয়, এটি বাংলা সংস্কৃতির এক অমর অধ্যায়। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর গান বেঁচে থাকবে হাজার বছর।
তাঁর প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে বাংলা সংগীত মহল। রবীন্দ্রসদনে তাঁর মরদেহ রাখা হলে হাজার হাজার অনুরাগী ভিড় করেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও উপস্থিত হয়ে শিল্পীর পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তিনি জানান, বাংলার গানে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সৃষ্টি বাংলার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
তাঁর আরও এক অমর সৃষ্টি— ‘এখনও গল্প লেখার সময় আছে কি?’ সময় কি আজও গল্প লেখার সুযোগ দেয়? নাকি সময়ের কাছে হার মেনেই বিদায় নিলেন শিল্পী? প্রতুল মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন, গানের মধ্যেই জাগ্রত হয় মানুষের চেতনা। ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি, বলে কেউ কি আমায় দেবে ছুটি?’— হয়তো প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু সময় তাঁকে ছুটি দেয়নি, বরং তাঁর গানের আলোয় তিনি আজও বেঁচে থাকবেন বাঙালির মনে।
তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ সচেতনতা এবং এক অনন্য বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা সংগীতকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল। ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে, প্রতিদিন পৃথিবী ঘোরে’— কিন্তু আজ প্রতুল মুখোপাধ্যায় নেই। সূর্য উঠবে, পৃথিবী ঘুরবে, বাংলা গান বাজবে— কিন্তু সেই সুরে আর তাঁর জীবনস্পর্শী কণ্ঠ থাকবে না।
তবে শিল্পী মরেন না, তাঁর সৃষ্টি তাঁকে অমর করে রাখে। ‘তোমার নামে লিখেছি, আঁকা নীল চোখ, তারি মাঝে খুঁজেছি ভালোবাসা’— বাংলা গানেও তাঁর ভালোবাসা চিরকাল অমলিন থাকবে। আজকের এই শূন্যতায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায় যেন গেয়ে উঠছেন, ‘আমার এ গান তোমায় দিলাম, তোমারই মনে রেখো।’ বাংলা সংগীতের অন্তরআকাশে চিরকাল ভাসবে তাঁর গান, তাঁর স্মৃতি, তাঁর সুর।