অভিজিৎ বসুর কলমে
আমাদের ছেলেবেলায় এত ‘দিবস’ পালনের আদিখ্যেতা ছিল না এইভাবে। সম্বৎসরে কেবল দুটি ‘দিবস’ পালিত হোত মাত্র। প্রজাতন্ত্র দিবস আর স্বাধীনতা দিবস। দুটিই বড় উত্তম ছিল কেননা ইস্কুল-মুখো হতে হোতনা সেদিন। ব্যস ফুল স্টপ। কিন্তু এখন দিন যে বদলে গেছে অনেকটাই। এখন দিবস পালনের হিড়িক পড়ে গেছে চারিদিক জুড়েই। কিলো কিলো দিবস আর সেই দিবস পালন। বেশ ভালই ব্যাপার কিন্তু কী বলেন। আজকের এই দিনটা যদিও একটু অন্য ধরনের। এই দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি মাথায় রাখা একটু ভালো। তা হোল এই দিবসটি মানুষের চেতনায় দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার অনুষঙ্গে। দু’-টুকরো রুটি আর সামান্য একটু মাখনের দাবিতে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমে মেয়েরা তীব্র আন্দোলন করেছিলেন সেইদিন। পরে ১৯১৭ সালে এই নারী দিবসই কাকতালীয়ভাবে রুশ বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ট্রটস্কির লেখায় আছে সামান্য নারী দিবস থেকে যে আন্দোলন বিপ্লবের দিকে মোড় নেবে তাঁরা কেউ সেটা আন্দাজ করতেই পারেননি একদম কিছুতেই। পাঁচ বছর পরে, ১৯২২-এর ৮ মার্চ তারিখটিকে লেনিন নারী দিবসের মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে দেন। এর ছয় দশক পরে তারিখটিকে নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় রাষ্ট্রপুঞ্জ। বলতে গেলে সেই থেকেই দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে নারী দিবস পালনের হুটোপাটি। আর আজ সারা বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে এই অমূল্য নারী দিবস।
এমনকি নারী-শাসনে প্রতি নিয়ত লাঞ্ছিত এই অভাগা পশ্চিমবঙ্গেও দিকে দিকে নারী দিবস পালনের হিড়িক পড়ে গেছে। যে রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত মহিলা ডাক্তার পৈশাচিক ধর্ষণ সয়ে লাশ হয়ে পড়ে থাকে, দেশ জুড়ে বিচার চেয়ে রাত জেগে আন্দোলন হয় কিন্তু বিচার মেলে না কিছুতেই কিংবা কলেজের বাচ্চা মেয়েদের গায়ের জোরে তুলে নিয়ে গিয়ে মহিলা পুলিশই সারা রাত ধরে নৃশংস অত্যাচার করে, সত্যিই কি অসাধারন বলুন তো। নারী দিবসে হান্টারওয়ালি দিদিদের ধিঙ্গি-নাচে সেই উদ্দাম বীভৎসার প্রতিধ্বনি শোনা যায়না কী? যে শুনতে পায় সে শোনে আর ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকে গুটিয়ে থাকে মুখ বুজে সব সহ্য করে। কমতে কমতে তেমন মানুষ দেখি এ রাজ্যে চড়ুই পাখির মতো প্রায় অদৃশ্য হওয়ার মুখে।হীনবল, ভীরু, নপুংসকে যে সমাজ ভরে গেল সেখানে সব দিবস পালনই সমান অর্থহীন। বিশেষ করে এই নারী-দিবস।
তাহলে এই আদিখ্যেতার দরকার কি ? এখনও যখন মেডিকেল কলেজের মতো নিরাপদ স্থানে পড়ুয়া ডাক্তার ধর্ষিত হয়,বরপণ না পেয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে বধূকে পুড়িয়ে মারা হয়, রাতে একা-একা পথচলতে মেয়েরা যখন শিউরে ওঠে ভয়ে,গলি ঘুঁজি পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্রতা, এখনও যখন পদে-পদে মেয়েদের কে ‘মেয়েছেলে’ বলে অবজ্ঞা করা হয়,এখনও যখন মেয়েরা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো প্রতিষ্ঠানে রামকৃষ্ণ বন্দনায় পুরুষের পেছনে বসে বন্দনা করে,মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারে না, পুজোয় পুরোহিত হিসেবে কাজ করতে পারে না,কেন না তারা ঋতুমতী হন,অশুচি বলে তাই, এখনও যখন আই-টি সেক্টরের মতো কিংবা এয়ার লাইন্সের মতো উচ্চ শিক্ষিত জায়গায় প্রতি নিয়তই অপমানিত হতে হয় ‘ মেয়ে’ বলে,বসের লালসার শিকার হয়ে অসহায় মেয়েদের চাকরী খোয়ানোর ভয়ে চুপ করে থাকতে হয় তখন এই নারী দিবস করে আদিখ্যেতার কি প্রয়োজন?কেন এই ভণ্ডামি? কেন এই দ্বিচারিতা? কেন এখনও অন্ত্যজ শ্রেণির মেয়েদের নানা ভাবে নির্যাতিত হতে হয়? কেন গবেষণারত তথাকথিত নিম্ন বর্ণের নারীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়? শ্রমজীবী মানুষের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে এখনও কেন মেয়েদের কম মজুরি দেওয়া হয়? কেন ঘরের কাজের মেয়েরা গর্ভবতী হলে স-বেতন ছুটি পাবে না? বিয়ের বাজারে কেন কালো মেয়েদের হীন চোখে দেখা হয়? কেন সেক্ষেত্রে বরপণ দ্বিগুণ থেকে আরও অনেকটাই বেড়ে যায়? এরকম বহু প্রশ্ন এসে যায়,বলতে ইচ্ছে হয় এ ভড়ং বন্ধ হোক,বন্ধ হোক এই আদিখ্যেতা।
একদিনের রাত দখলে নারী স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় না হে বালক,চাই ধারাবাহিক প্রতিনিয়তই আন্দোলন।চাই মননের পরিবর্তন, প্রকৃত মানবতাবাদী শিক্ষা ও প্রয়োগ। স্টেজে ওঠে গলা কাঁপিয়ে শুধু আবৃত্তি করলেই হবে না,’ নারী রে আপন ভাগ্য জয় করিবার, হে বিধাতা, কেন নাহি দিবে অধিকার..’ বিধাতা কিস্যু দিবে না,সে তো ঠুঁটো জগন্নাথ! নারীকেই লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হবে সেই অধিকার আর সেই লড়ায়ের সহযোগী হবে বাকি অর্ধেক মানুষ। বড় বড় কথা বলব,মিটিং মিছিল সেমিনার করব আর বাড়ি ফিরে বৌকে ধরেধরে পেটাব নয় পদে-পদে ‘মেয়েছেলে’ বলে অপমান করব – এই মন নিয়ে ‘ নারীদিবস ‘ উদযাপনের দরকার আছে কি? কে জানে শুধু তো একটা গোটা দিন পালন করা নয়। যে মেয়ে, যে ঘরের বউ, যে মা, যে প্রেমিকা, যে ভালোবাসার জন আমাদের সবার প্রিয় ঘরের মানুষ, কাছের মানুষ তাহলে তাদেরকে কেনো এমন ভিন্ন চোখে দেখা। সেই নারীর সমমনস্ক আমরা হতে পারছি কই। নারীর যন্ত্রণায় সমব্যাথী না হতে পারলে তাহলে এই দিবস পালন অর্থহীন।