সম্প্রতি, বিহারের বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব যখনই মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারকে আক্রমণ করতে চেয়েছেন, তখনই নীতিশ তাঁর রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টেনে এনে তাঁকে ‘বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করেছেন। চলমান বাজেট অধিবেশনে নীতিশ কুমার আরও একধাপ এগিয়ে জানান, ১৯৯০ সালে তেজস্বীর বাবা এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) প্রধান লালু প্রসাদকে মুখ্যমন্ত্রী করার পেছনে তিনিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
৪ মার্চ, সংসদে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেন, “আমিই তোমার বাবাকে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছি। তোমার জাতের লোকেরাও তাকে মুখ্যমন্ত্রী করার বিরোধিতা করেছিল, তবুও আমি তাকে সমর্থন করেছিলাম।” নীতীশের এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব বিধানসভা থেকে ওয়াক আউট করেন।
এই ঘটনা আমাদের ১৯৭৪ সালের রাজনীতির দিকে নিয়ে যায়, যখন লালু প্রসাদ প্রথমবারের মতো পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের (PUSU) সভাপতি হিসেবে আলোচনায় আসেন। তখন ছিল জেপি আন্দোলনের সময়, যখন রাজ্যসহ ভারতের বিভিন্ন অংশে কংগ্রেস-বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই সময়, বিহার কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রনেতা নীতীশ কুমারও সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন।
তবে শুরু থেকেই তাদের রাজনৈতিক পথ ভিন্ন ছিল। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার পর ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে লালু প্রসাদ ছাপড়া থেকে বিজয়ী হন। অন্যদিকে, নীতীশ কুমার একই বছরে বিধানসভা নির্বাচনে এবং ১৯৮০ সালে নালন্দা জেলার হারনৌত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। শেষ পর্যন্ত, ১৯৮৫ সালে তৃতীয় প্রচেষ্টায় তিনি প্রথমবারের মতো বিধানসভা আসন জয় করতে সক্ষম হন। সেই সময়, লালু ও নীতীশ দুজনেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কারপুরী ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন লোক দলের সদস্য ছিলেন, এবং সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্বের শুরু হয়।
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারপুরী ঠাকুরের মৃত্যুর পর, লালু প্রসাদ, শিবানন্দ তিওয়ারি, নীতীশ কুমার, রঘুবংশ প্রসাদ সিং, জগদানন্দ সিং এবং বিজয় কৃষ্ণ ছিলেন লোক দলের দ্বিতীয় সারির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তবে, তখনও বিহারের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিনায়ক প্রসাদ যাদব, অনুপ লাল যাদব ও গজেন্দ্র হিমাংশুর প্রভাব ছিল, যাঁরা লালু ও তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় সিনিয়র ছিলেন। ঠিক এই সময়েই, লালু তাঁর স্বভাবসুলভ কৌশল ও গ্রাম্য আকর্ষণ দিয়ে প্রবীণ যাদব নেতাদের ছাপিয়ে কারপুরী ঠাকুরের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হওয়ার দাবি জানান।
হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী দেবী লালের ঘনিষ্ঠ শরদ যাদব ১৯৮৯ সালে অনুপ লাল যাদবকে বিহারের বিরোধী দলনেতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শিবানন্দ তিওয়ারি ও নীতীশ কুমার লালুর পক্ষে অবস্থান নেন। ২০১৫ সালে, এক সাক্ষাৎকারে নীতীশ বলেছিলেন, “আমরা লালু প্রসাদকে সমর্থন করেছিলাম কারণ তিনি আমাদের প্রজন্মের নেতা ছিলেন। তাঁকে সমর্থন করে আমরা আমাদের প্রজন্মের জন্য শক্তি আনতে চেয়েছিলাম।” ফলে, লালু বিরোধী দলনেতা হন এবং জনতা দলের বিহার শাখার নেতৃত্ব পান।
১৯৯০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জনতা দল নির্দিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা না করলেও দলের মধ্যে রাম সুন্দর দাসের মতো সিনিয়র নেতারা ছিলেন। তখন পর্যন্ত ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং দলটি তিনটি শিবিরে বিভক্ত হয়—ভিপি সিং, দেবী লাল ও চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে। নির্বাচন শেষে, ভিপি সিং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাম সুন্দর দাসকে চাইছিলেন, কিন্তু দেবী লাল লালুর পক্ষে ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে লালু চন্দ্রশেখরের সমর্থন চাইলেন। চন্দ্রশেখর উত্তর বিহারের শক্তিশালী নেতা রঘুনাথ ঝাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চাইছিলেন, তবে তিনিও জানতেন যে তাঁর জয়ের সম্ভাবনা কম। দাসকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে শেষ পর্যন্ত চন্দ্রশেখর লালুর পাশে দাঁড়ান। দলের অভ্যন্তরীণ ভোটাভুটিতে লালু ৫৯ ভোট, দাস ৫৬ ভোট ও ঝা ১৪ ভোট পান। ঝার ভোটই লালুর বিজয় নিশ্চিত করে। সেই সময় নীতীশ কুমার ও শিবানন্দ তিওয়ারি লালুর পক্ষে শক্তিশালী লবিং করেছিলেন। পরবর্তীতে, বিজয়বন্ত চৌধুরী বলেন, “আমি চন্দ্রশেখরের শিবিরে ছিলাম, কিন্তু দেখেছি কীভাবে নীতীশ ও শিবানন্দ কঠোর পরিশ্রম করে লালুর জন্য সমর্থন আদায় করেছেন।”
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে, যখন ভিপি সিং বিহারে প্রচারণায় এলেন, তখন লালু তাঁকে কটাক্ষ করে বললেন, “রাজা সাহেব, দয়া করে আমার আসন থেকে সরে যান।” ভিপি সিং আর পাল্টা প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে লালুর দাবি মেনে নেন।
অন্যদিকে, নীতীশ কুমার ১৯৯৪ সালে জনতা দল থেকে বেরিয়ে এসে জর্জ ফার্নান্দেজের সঙ্গে সমতা দল গঠন করেন। জেপি আন্দোলন থেকে একসঙ্গে পথচলা লালু ও নীতীশ এখান থেকেই আলাদা হয়ে যান এবং বিহারের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়। যদিও ২০১৫ ও ২০২০ সালে তাঁরা দুই দফায় একসঙ্গে এসেছিলেন, কিন্তু দুইবারই সেই জোট টেকেনি।
নীতীশ যখন বিধানসভায় তেজস্বী যাদবকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন যে তিনিই লালুকে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছেন, তখন হয়তো তিনি আসলে সেই সময়ের কথাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন—যখন তিনিই ছিলেন লালুর অন্যতম বড় সমর্থক।