শান্তিনিকেতন আর বসন্ত উৎসব যেনো বাংলা সংস্কৃতির বিশিষ্ট একটি নান্দনিক পরিসর রচনা করেছে সে-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। আর শান্তিনিকেতনের নান্দনিকতার ইতিহাসে ‘বসন্তোৎসব’ অবশ্যই বিশিষ্টতর। যে বসন্ত উৎসব নিয়ে এখন জোর আলোচনা আর সমালোচনাও। যে বসন্ত উৎসব শুরু হয়েছে দোল উৎসবের আগেই বিশ্বভারতীতে। যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। সব মিলিয়ে সেই পুরোনো দিনের কবির প্রাণের বসন্ত উৎসব যেনো ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেছে অনেকটাই। যেখানে আর দখিন দুয়ার খুলে বেরিয়ে পড়া যায়না বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাসে ভেসে দু হাত তুলে মনের আনন্দে বলা যায়না লাগলো রে দোল। আমরা ইতিহাস এর পাতা উল্টে পাই যে ১৯০৭ সালের ‘শ্রীপঞ্চমী’ তিথিতে বালক শমীন্দ্রনাথই শান্তিনিকেতনে ‘বসন্তোৎসব’-এর সূচনা করেছিলেন। কথাটা ঠিক ঠিক বললে বলতে হয় বালক শমী ১৩১৩ বঙ্গাব্দের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে শান্তিনিকেতনে যদি সে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেও থাকেন তাহলে তা ছিল একটি শুধু মাত্র এই ঋতু উৎসব , বসন্তোৎসব নয়। যে ঋতু আমাদের মন প্রাণকে ভরে দেয়। আমরা আনন্দে বলে উঠি, লাগলো রে দোল। সাধারণ ভাবে এটাই প্রচলিত। রবীন্দ্রজীবনী – কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, সেই উৎসবে ‘শমীন্দ্র এবং আরো দুইজন ছাত্র বসন্ত সাজে, একজন সাজে বর্ষা; আর তিনজন হয় শরৎ এই হলো শুরু। আর প্রকৃতি সেজে উঠলেই আশ্রমিকদের মধ্যে তখন গুনগুনিয়ে উঠত ‘বসন্ত’। বসন্তকে আবাহন করার জন্য ফাল্গুনী পূর্ণিমা পর্যন্ত অপেক্ষাও তখন তেমন আবশ্যক হয়ে ওঠেনি সেই সময়। যেমন, ১৯২৩ সালের মাঘীপূর্ণিমায় শান্তিনিকেতনে বসন্তের গানের আসর বসেছিল। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম সম্মিলনীর অধিবেশনে আবারও হয় বসন্তোৎসব। সেই সময় আবির খেলা হতো। আশ্রমের অধ্যাপক ছাত্র ছাত্রীরা এই আবীর খেলায় মেতে উঠতেন। খোল করতাল বাজিয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণ করা হতো। আর সেই সঙ্গে ‘যা ছিল কালোধলো / তোমার রঙে রঙে রাঙা হলো।’—গানে সেবার ভরে উঠেছিল আশ্রম-অঙ্গন। দোলের দিন আবিরে-আম্রপল্লবে বসন্তের আমন্ত্রণলিপি আশ্রমিকদের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যেত সেই প্রাক্-বসন্তোৎসব পর্বের শান্তিনিকেতনে। সেটাই তো শান্তিনিকেতনের চিরচেনা ছবি। যে ছবি আজ অনেকটাই কেমন ফাঁকা লাগে যেনো। সব থেকেও কিসের যেনো অভাব। ১৯২০-র দশকে বিশ্বভারতী হওয়ার আগের পর্বেও দোলের দিন শান্তিনিকেতনে বসন্ত-উদ্যাপন ছিল, কিন্তু রীতিমতো আশ্রমিক-উৎসব সম্ভবত তখনও তা হয়ে ওঠেনি। তার জন্য অপেক্ষা ছিল ১৯২৩ সাল পর্যন্ত। ১৯২৬ সালে বসন্তোৎসব অনুষ্ঠিত হয় ৪ চৈত্র ১৩৩২ তারিখে। অনুমান করা যায়, এই দিনটিতেই ছিল বসন্ত-পূর্ণিমা। সেবার ‘নটরাজ’-এর ‘আবাহন-গীতিকা’ (‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’) নৃত্যছন্দে অভিনীত হয়েছিল। ১৯৩১-এর ৪ মার্চ লাইব্রেরির বারান্দায় (বর্তমান পাঠভবন অফিস) বসন্তোৎসব উপলক্ষে ‘নবীন’ নাটিকাটির অভিনয় হয়। সাবিত্রী গোবিন্দের গানও ছিল সেবারের অন্যতম আকর্ষণ। রমা চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন,‘মরি হায় চলে যায় বসন্তের দিন’ গানটির সঙ্গে কীভাবে নাচতে হবে তার নির্দেশনা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর ‘গুরুদেব’-এর কাছ থেকেই। ‘ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল’ গানটির সঙ্গে সেবার নেচেছিলেন অমিতা সেন। শান্তিদেব ঘোষও ১৯৩১ সালের ওই ‘দোলের উৎসব’-এর আলাদা উল্লেখ করেছেন একটি সাক্ষাৎকারে। ভ্রাতুষ্পুত্র শমীক ঘোষকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে শান্তিদেব বলেছেন, তখন ‘বসন্তোৎসব’ বলতে কিছু ছিল না। সবাই মিলে আবির খেলা, গান গাওয়া—এসবই করা হত। সন্ধ্যায় থাকত কোনো অনুষ্ঠান। দোলের শোভাযাত্রার সঙ্গে ১৯৩১-এ ‘নবীন’ নাটকের জন্য লেখা ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটি অবশ্য তখনও যুক্ত হয়নি। খুব নির্দিষ্ট করেই তিনি বলেছেন, সকালের শোভাযাত্রার নাচটা ‘১৯৩৪ সালের আগে পর্যন্ত হতো না।’ ১৯৩১-এ দোলের আনন্দ-আসরে শান্তিদেব আর কলাভবনের ছাত্র বনবিহারী ঘোষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাউলের ভঙ্গিমায় নেচে উঠেছিলেন। সে নাচের সুখ্যাতি কবির কানেও পৌঁছেছিল। শান্তিদেব বলেন: “আগের দোল-উৎসব যেটা হতো, সেটাকে গুরুদেব আর বেশি উৎসাহ দিলেন না কারণ ঐ সময় নানারকম নোংরামি হতো। নোংরামি মানে কী—কাদা দিয়ে দিল, ছেলেরা দুষ্টুমি করে কালি দিয়ে দিল—এরকম এলোমেলো ভাব। উনি[রবীন্দ্রনাথ] ভাবলেন, এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁধে দিতে হবে। উনি সকালে ‘বসন্তোৎসব’ ব’লে একটা বিধিবদ্ধ উৎসব করা ঠিক করলেন। তখন থেকে আরম্ভ হলো সকালবেলার অনুষ্ঠান—তাতে গান হবে, কিছু নাচ হবে—ছেলেমেয়েরা নাচবে, গুরুদেব আবৃত্তি করবেন। তখন থেকে ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটার সঙ্গে নানারকম অর্ঘ্য নিয়ে মেয়েরা আসত। ”আম্রকুঞ্জে বেশ যত্ন করে নিকোনো একটা মণ্ডলী বা বেদিতে বসত গানের দল। আমগাছগুলোকেও ভালো করে সাজিয়ে দেওয়া হত। ‘বসন্তকালে গাছপালাও যে উৎসবের একটা অঙ্গ’—তা মনে রাখা হত তখন। পঞ্চাশের দশকের বসন্তোৎসব প্রত্যক্ষ করেছেন এমন অনেক প্রবীণ আশ্রমিকের স্মৃতি চারণায়, একটা প্রকাণ্ড রেকাবি বা পরাতে চূড়া করে রাখা হত আবির। অনুষ্ঠান শেষে সেই আবির নিয়ে একে অপরকে মাখাতেন সবাই। আশির দশকের গোড়া পর্যন্ত আম্রকুঞ্জেই অনুষ্ঠিত হত শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। ১৯৮১ সালে আম্রকুঞ্জের গাছে চড়ে বসা অত্যুৎসাহী দর্শকদের ভারে ভেঙে পড়ে আমের ডাল। তারপরই বসন্তোৎসবের আম্রকুঞ্জপালা শেষ হয়ে গৌরপ্রাঙ্গণ পর্ব শুরু হয়। শান্তিদেবের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ১৯৩১ বা তার আগে সকালের আনন্দ-আসরে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকতেন না। ১৯৩২ থেকে শান্তিনিকেতনের দোল-উৎসব ‘বসন্তোৎসব’ হয়ে ওঠার পর রবীন্দ্রনাথ সকালের অনুষ্ঠানেও যোগ দেওয়া শুরু করেছিলেন। তার চেয়েও বড়ো কথা, এইসময় থেকেই অনুষ্ঠানের প্রকরণগত দিক থেকেও এল খুব বড়োরকম একটা পরিবর্তন। আমাদের চেনা বসন্তোৎসবের সূচনা এই সময় থেকেই।
১৯৩৫ সালে বসন্তোৎসব পড়েছিল ২০ মার্চ তারিখে। এখনকার মতো তখনও ছিল এক-একটা রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে এক-একটা নাচ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবনী’-র চতুর্থ খণ্ডে সেবারের অনুষ্ঠানে নাচের দলের যে-তালিকা পাওয়া যায় তাতে আছে ইন্দিরা নেহরুরও নাম। চৌদ্দটি গানের মধ্যে ‘কে দেবে চাঁদ, তোমায় দোলা’ এবং ‘তোমার বাস কোথা হে পথিক’ গানদুটির সঙ্গে অন্যান্যদের সঙ্গে নেচেছিলেন ছাত্রী ইন্দিরা। আর সকালের মূল অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ‘ফাল্গুনী’ থেকে কিয়দংশ পাঠ করার পর এবছর ‘বসন্তোৎসবের মর্মকথা’ ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই ছিল সেই আমলের শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব। যে উৎসবের ইতিহাস আর তার গুরুত্ব আলাদা ঐতিহ্যে বহন করে। ১৯৩৬ সালের ৮ মার্চ দোল পূর্ণিমার দিনেই বসন্তোৎসব হয়। সদ্যপ্রয়াত (২৮ ফেব্রুয়ারি) কমলা নেহরুর স্মরণে কবি সেদিন সকালে মন্দির-ভাষণে বলেন, ‘আজ হোলির দিন, আজ সমস্ত ভারতে বসন্তোৎসব। আমাদের আশ্রমের এই বসন্তোৎসবের দিনকেই সেই সাধ্বীর স্মরণের দিন রূপে গ্রহণ করছি।’ বসন্তোৎসবের দিনটিকে প্রয়াতের স্মরণেরও দিন হিসেবে গ্রহণ করে বক্তৃতা করেছিলেন কবি। তাঁর সেই ভাষণের মধ্যেই নিহিত ছিল কবির চিরকালীন বসন্তভাবনার অন্তঃসার। রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ উচ্ছ্বাস বা উন্মাদনার ঋতু নয়। তার খুব গভীরে থাকে একরকম বিরহচেতনাও। এখানে উল্লেখ্য, তিরিশের দশক থেকে বসন্ত-উৎসব উপলক্ষে কবিকে বিশেষ ভাষণ দিতেও দেখা যায়। কবির প্রয়াণের পরও বসন্তোৎসবে ভাষণের এই ধারা অব্যাহত থাকে কিছুকাল। তখন উৎসবে আচার্যের ভূমিকা পালন করতেন ক্ষিতিমোহন সেন। সেই কবির প্রিয় কাল, প্রিয় ঋতুর এই শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব ধীরে ধীরে কেমন যেন রূপ বদলে ফেললো। নিজের সেই চেনা ছবি কেমন করে যেন অচেনা হয়ে গেলো। সেই আম্রকুঞ্জ, গৌরপ্রাঙ্গন, সব কিছুই আছে। সেই ২০১৮ সালে এই বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে যে পদপিষ্ট হবার ঘটনা ঘটে তাতেই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাইরে আর বসন্ত উৎসব সর্বসাধারনের জন্য নয় বলে ঘোষণা করে দেয়। এমনকি দোল এর আগেই ভীড় এড়াতে আগেই বসন্ত উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু একাল আর সেকালের সেই বসন্তের সমীরণে বসন্তের উৎসবে ফারাক আকাশ আর পাতাল। আজ বাইরের মানুষের ভীড় উপচে পড়ছে। হোটেলে আর রিসর্টে থিক থিক করছে ভীড়। শহর কলকাতা থেকে ছুটে আসছেন বসন্ত উৎসবে সামিল হতে হাজার হাজার মানুষ এই শান্তির নিকেতনে। রঙিন ফুলের মালা গলায় দিয়ে মনের আনন্দে নেচে গেয়ে উঠবেন সবাই মিলে, লাগলো রে দোল। আর তখন সেই সাদা কালো যুগের আমলে সেই কবির প্রিয় বসন্ত উৎসবের সুর ভেসে আসবে দুর থেকে, উচ্ছাস নয় আনন্দ নয় কবির চেতনায় এই বসন্ত তো বিরহী হয়েই ধরা দেয় বারবার। যে পাতাঝরা বসন্ত বিরহের গান গেয়ে বলে ওঠে,
যদি তারে নাই চিনি গো সে কি,
আমায় নেবে চিনে , এই নব ফাল্গুনের দিনে।
Leave a comment
Leave a comment