বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ঋত্বিক ঘটক এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়, যাঁর সৃষ্টি আজও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আলোচনার বিষয়। জন্মশতবর্ষে তাঁর অবদান নতুন করে মূল্যায়িত হচ্ছে। জনপ্রিয়তার বিচারে তিনি হয়তো মূলধারার বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করেননি, কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতা বাংলা সিনেমার ভাষাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে।
ঋত্বিক ঘটকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আগেও তৈরি হয়েছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এবার সেই পথ ধরে আসছে ‘অলক্ষ্যে ঋত্বিক’। পরিচালক শুভঙ্কর ভৌমিক এই ছবির মাধ্যমে ঘটকের জীবন, তাঁর ভাবনা ও সিনেমার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিলাজিৎ মজুমদার।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অযোগ্য’ ছবিতে প্রশংসিত হওয়ার পর এবার আরও কঠিন চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরতে চলেছেন শিলাজিৎ—বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায়। কিন্তু চেহারার কাঠামো, শারীরিক গঠন কিংবা মুখাবয়বে ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য প্রায় নেই বললেই চলে। তবু চরিত্রের গভীরে পৌঁছনোর চেষ্টায় তিনি প্রস্তুত।
চরিত্রের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে তিনি额 মাথার সামনের অংশের চুল ফেলে দিয়েছেন, মুখের গড়নে পরিবর্তন আনতে ব্যবহার করেছেন নকল দাঁত। তবে এত কিছু করেও কি তিনি ঋত্বিক ঘটকের মতো হয়ে উঠতে পেরেছেন? সে বিষয়ে নিজেও নিশ্চিত নন।
তাহলে শারীরিক অমিল থাকা সত্ত্বেও এই চরিত্রে অভিনয় করতে তিনি রাজি হলেন কেন? শিলাজিতের স্পষ্ট বক্তব্য, “ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে অভিনয় করা নিঃসন্দেহে এক বিরল অভিজ্ঞতা। এই কাজের মাধ্যমে তাঁর নামের সঙ্গে আমার নাম চিরদিন জড়িয়ে যাবে, এটুকুই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
শিলাজিৎ পরিচালকের পরিকল্পনা সম্পর্কে পুরোপুরি আশ্বস্ত নন। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, প্রস্থেটিক মেকআপের সাহায্যে তাঁকে ঋত্বিক ঘটকের মতো দেখানো হবে। তবে দীর্ঘসময় রূপটান নেওয়ার পর আয়নায় নিজেকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, চেহারার মিল ঠিক আসছে না। কখনও মনে হচ্ছিল তিনি যেন অশোককুমার, কখনও সলিল চৌধুরীর মতো লাগছেন! তাই কৃত্রিম মেকআপের পরিবর্তে তিনি নিজেই চেহারায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেন। কপালের সামনের অংশের চুল কামিয়ে ফেলেন, নকল দাঁত পরেন—সব মিলিয়ে চেষ্টা করেন ঘটকের আদল ধরতে।
চরিত্রটি বোঝার জন্য শিলাজিৎ ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দেখেছেন। তবে অভিনয়ে কতটা সফল হতে পেরেছেন, তা নিয়ে নিশ্চিত নন তিনি। শিলাজিতের কথায়, “আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু নিজেকে পর্দায় দেখে মনে হয়েছে, আরও ভালো করতে পারতাম।” ছবিতে তাঁর বিপরীতে ‘সুরমা ঘটক’-এর চরিত্রে রয়েছেন পায়েল সরকার। তাঁর পারফরম্যান্স প্রসঙ্গে শিলাজিৎ বলেন, “পায়েলও নিজের মতো করে চরিত্রটা ধরার চেষ্টা করেছে। আমার তুলনায় ওর কাজ আরও বেশি নিখুঁত লেগেছে।”
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখেছিলেন শিলাজিৎ, তবে খুব বেশি দেখার ইচ্ছা ছিল না তাঁর। কারণ, তিনি চাননি অন্য কারও অভিনয়ের ধরণ নিজের ওপর প্রভাব ফেলুক। চরিত্রটি একেবারে নিজের মতো করেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।
অন্যদিকে, সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘পদাতিক’ প্রশংসা পেলেও বক্স অফিসে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। সেই প্রসঙ্গ টেনেই শিলাজিতের প্রশ্ন, ‘অলক্ষ্যে ঋত্বিক’-এর ভাগ্যে কী রয়েছে? তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট—“ঋত্বিক ঘটক নিজেই কখনও বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য সিনেমা বানাননি। বরং তিনি মূলধারার বাইরে গিয়েই চলচ্চিত্রের এক নতুন ভাষা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে নিয়ে তৈরি ছবি ব্যবসায়িকভাবে কতটা সফল হবে, তা বলা সত্যিই কঠিন।”
তবে পরিচালক শুভঙ্কর ভৌমিকের কাছে বাণিজ্যিক সাফল্যের চেয়ে ছবির বিষয়বস্তুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিশ্বাস, “মূল লক্ষ্য ব্যবসা নয়, বরং ঋত্বিক ঘটকের ভাবনা ও দর্শন আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।” এখন প্রশ্ন একটাই—দর্শক এই প্রয়াসকে কীভাবে গ্রহণ করবেন?
Leave a comment
Leave a comment