বুদ্ধদেব পাত্র
দিনভর রোজা রেখে সন্ধ্যায় কৃষ্ণ সেজে আসর জমান ছৌ শিল্পী গিয়াসুদ্দিন
দিনভর রোজা রাখেন,নমজাও পড়েন,আবার সন্ধ্যায় দুর্গা, গণেশ কার্তিক শ্রীকৃষ্ণ সেজে ছৌ নাচের আসর জমান। পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের পলমা গ্রামের গিয়াসুদ্দিন আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল।
ভোরে ওঠে নামাজ পড়েছেন দিনভর রেখেছেন রোজা। এরই মাঝে গ্রামের বাড়ির গাছ গাছালির ছাওয়ায় দেব দেবীর সাজে ছৌ শিল্পীদের দিচ্ছেন তালিম। নিজেও সেজেছেন কৃষ্ণ। সাথে নিজের পুত্রকেও দিচ্ছেন তালিম। এক কথায় দিনভর রোজা রেখে কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা সেজে আসর জমাচ্ছেন জঙ্গলমহলের ছৌ শিল্পী গিয়াসুদ্দিন আনসারি।পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের বরাবাজার ব্লকের পলমা গ্রামের বিখ্যাত ছৌ শিল্পী গিয়াসুদ্দিন আনসারি ১২ বছর বয়স থেকে এভাবে দেব দেবীর সাজে করে আসছেন ছৌ নাচ। ১৯৯৬ সালে ১৪ বছর বয়সে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার।১২ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ছৌ নৃত্যের জন্য পেয়েছেন কেন্দ্র সরকারের বৃত্তি। গিয়াসুদ্দিন আনসারী জানান।ছৌ নাচ মানেই দেব দেবীর সাজ। এই দেবদেবীর সাজে ছৌ নাচ তার ঠাকুরদা,বাবা সকলেই করে এসেছেন। তিনিও করছেন। এতে ধর্মের ভেদাভেদ নেই, আগে কর্ম পরে ধর্ম শিল্পীদের আবার জাত কোথায়”। গিয়াস উদ্দিনের বলতে দ্বিধা নেই, রোজা রমজান পালন করে হিন্দুদের দেবদেবীর সাজে ছৌ নাচ করার জন্য তাকে নিয়ে নানান কটাক্ষ হয়, নানান চর্চা চলে। কিন্তু এতে তিনি পাত্তা দেন না। কে কি বলল তাতে যায় আসে না।
জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার বরাবাজার ব্লকের প্রান্তিক গ্রাম পলমা। গ্রামের কৃষিজীবী পরিবার থেকে ছৌ নাচে প্রথম নাম লেখান গিয়াস উদ্দিনের ঠাকুরদা হাজারী আনসারী। সে পথেই হেঁটেছেন তার ছেলে জুমেরউদ্দিন। এখন গিয়াসুদ্দিনের সঙ্গে তালিম নেন তার ছেলে কাইফউদ্দিনও।গিয়াসউদ্দিন এখন ছৌ দলের ওস্তাদ। তৈরি করেছেন “পলমা শক্তি সংঘ ছৌ নৃত্য পার্টি”।দলে রয়েছেন ৩০ জন সদস্য। তার মধ্যে ২২ সদস্যই হিন্দু,মুসলিম জনা আটেক। যদিও তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সদল বলে অনুষ্ঠান করতে ভিন রাজ্যে গেছেন একাধিকবার।
গিয়াস উদ্দিনের এই ছৌ নাচ নিয়ে নানান কটাক্ষ,নানান চর্চা হলেও ছৌ নাচই আজ তার ধ্যান জ্ঞান। বাবার এই কর্মযজ্ঞে শামিল পুত্র কাইফ উদ্দিন। তিনিও গর্বের সাথে জানান পূর্বপুরুষদের দেখানো ছৌ নাচের পথেই তিনিও হাঁটবেন। চালিয়ে যাবেন ছৌ নাচ।
গিয়াস উদ্দিনের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। গিয়াসুদ্দিনের হাতে তৈরি পলমা শক্তি সংঘ ছৌ নৃত্য দলের ম্যানেজার নারায়ণ চন্দ্র মাহাতো বলেন। নিজের ধর্ম বজায় রেখে রোজা রমজান করেও পুরুলিয়ার সংস্কৃতি ধরে রেখেছেন।ছৌ নাচ করতে গিয়ে কোথায় মসজিদ, কোথায় নমাজ পড়বেন সব রকম ব্যবস্থা করে সব রকম সহযোগিতা করে থাকি।
গিয়াসুদ্দিন এর দাদা জালালুদ্দিন আনসারিও ছৌ শিল্পী।তিনিও শিব সেজে গিয়াসুদ্দিনের দলে ছৌ নাচ করেন। তারও সোজাসাপ্টা জবাব,”ধর্ম ধর্মের জায়গায়।এটা তাদের পেশা। শিব সাজলেই তিনি তো শিব হয়ে যাচ্ছেন না।এটা তো অভিনয়।”
গিয়াসুদ্দিনের দলে রয়েছেন বিপদতারণ পরামানিক, কবিরাজ রজকরা। তারাও একযোগে জানান গিয়াসুদ্দিনের মত ছৌ শিল্পীর সাথে কাজ করতে পেরে তারা দারুণ খুশি,তারা আজ গর্বিত।