অভিজিৎ বসু।
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল, বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল। এই কথা তো কবির কথা। সত্যিই কত সুন্দর কথা তিনি লিখলেন এই বসন্তের ঋতুকে স্মরণ করে। সত্যিই তো নীল দিগন্তে যে ফুলের আগুন কোনোদিন লাগতে পারে সেটাই বোধহয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আজ থেকে এত বছর আগেও। যে আগুনে পুড়ে মরতে বড়ো ভয় লাগতে পারে কোনো সময়। আর তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন এই বিখ্যাত গান। যে গান আমাদের কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো।
তবে আমি ফুলের আগুন না দেখতে পেলেও যেটা আজ বিধানসভার অন্দরে দেখতে পেলাম সেটাও কি কম বড়ো আগুন। যে আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে জ্বলতে কেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আজ রাজ্যের চারিদিকেই। যে আগুন যে শুধু বসন্তের লাল পলাশ ফুলের হাসিমাখা ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে আমি দেখতে পাচ্ছি সেটা নয়। সেই আগুন বসন্ত, শীত, শরৎ আর হেমন্ত আর বর্ষাতেও সমানভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে এদিক থেকে ওদিক। পাহাড় থেকে সমুদ্রে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। হুগলী থেকে হাওড়া। কাকদ্বীপ থেকে কুচবিহার। বসিরহাট থেকে মাদারিহাট রাজ্যের সর্বত্রই।
সেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ছে বিধানসভার অন্দরে। একপক্ষের হাতে হিন্দুত্বের ট্রাম্প কার্ড আর অন্য পক্ষের হাতে সংখ্যালঘুর টেক্কা। সেই নিয়েই চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যে যুদ্ধ সত্যিকার শুরু হলে আমরা কে কোথায় থাকবো কেউ জানি না। শুধু ভোটের রাজনীতি করতে গিয়েই এই আগুন নিয়ে খেলা। আর তাই বোধহয় আজ ধনধান্যে “দোলি” উৎসব পালন করা হলো। নাচে গানে মেতে উঠলেন অনেকেই। বসন্ত উৎসবে যোগ দিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধনধান্যে অডিটোরিয়ামে হলো এই অনুষ্ঠান। বুধবার সন্ধ্যায় ঠিক দোল উৎসবের আগেই এই “দোলি” উৎসব পালন করা হলো। আয়োজক কলকাতা কর্পোরেশন।
সত্যিই অসাধারণ এই অনুষ্ঠান। নাচে, গানে মেতে উঠলেন সকলেই। ডান্ডিয়া হাতে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং যোগ দিলেন এই অনুষ্ঠানে। একদম যেনো ফিরে গেলেন সেই বসন্তের রঙিন ছোঁয়ায় অতীত দিনে। বেশ ভালো লাগলো দেখে আমার। সত্যিই ৩৪ বছরের বাম শাসনে এই “দোলি” উৎসব কি চোখে পড়েছে। ঠিক মনে পড়ছে না তো আমার। যদিও বয়স হচ্ছে তো ভুলে যাই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে অনেক কিছুই হারিয়ে যায় আর কি আজকাল। কিন্তু জ্যোতি বসুর আমলে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে এই “দোলি” উৎসব নৈব্য নৈব্য চ। আচ্ছা এই “দোলি” কেনো? আমি কি ভুল লিখলাম। হোলি শুনেছি, দোল শুনেছি কিন্তু “দোলি” কি ঠিক লিখলাম তো। না হলে আবার সব রে রে করে উঠবে এই বলে যে ভুল লেখার জন্য মাশুল না দিতে হয় আমায় আবার দিনকাল যা পড়েছে।
না, না, ভুল নয় একদম ঠিক লিখেছি আমি। হোলি আর দোল এর মিশ্রণে তৈরি হলো এই রাজ্যে “দোলি” উৎসব। যে দোল হিন্দুদের পবিত্র উৎসব। যে দোল এর দোলযাত্রা একটি জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ হিন্দু উৎসব। যা বসন্ত, প্রেম এবং রঙের উৎসব নামেও পরিচিত এটি ৷ এটি রাধা ও কৃষ্ণের শাশ্বত ও ঐশ্বরিক প্রেম উদযাপন করে। আর এই হোলিকা দহন অশুভ শক্তির বিপরীতে শুভের জয় নির্দেশিত করে। রাক্ষস রাজা হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। সেই কারণে প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে আগুনে নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করেন। বিষ্ণুর কৃপায় আগুন প্রহ্লাদকে স্পর্শ করতে না পারলেও সেই আগুনে পুড়ে মারা যান হোলিকা। তার তাই হোলি হল অশুভ শক্তির পরাজয় ও শুভ শক্তির জয়ের প্রতীক। তাই হোলির আগেরদিন হোলিকা দহন পালন করা হয়। যা নন বেঙ্গলি হিন্দুদের পবিত্র উৎসব।
তাহলে দোল আর হোলি মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে আমাদের জীবনে। যে জীবনে জড়িয়ে আছে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত আমাদের সবার কাছে। যে কারণে এই বার প্রথম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই “দোলি” উৎসব পালন করলেন সরকারী ভাবে কার্ড ছাপিয়ে নানা অনুষ্ঠান করে। একদম মেপে মেপে পা ফেলে। হিসেব করে ইঞ্চি মেপে। যে হিসেবে খুব একটা ভুল তিনি তাঁর এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খুব একটা করেন না কোনওদিন। সেটা তাঁর সবথেকে বড় প্লাস পয়েন্ট। রাজনৈতিক প্রত্যুতপন্নমতিত্বে তিনি অন্য অনেকের থেকে যে এগিয়ে সেটাই বুঝিয়ে দেন তিনি বারবার। বিরোধী রাজনৈতিক দল যদি হিন্দুত্বের ট্রাম্প কার্ড খেলে ভোটে জয়ী হতে চায়, রাজ্য দখল করতে চায় তাহলে তাঁর আর সংখ্যালঘু টেক্কা হাতে আছেই। খাতায় কলমে ২৮ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট কিন্তু আসলে সেটা প্রায় ৩৪ শতাংশ তো বটেই। সেটা নিয়েই তো এতদিন নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি।
কিন্তু ওই যে একেবারে ফিতে ফেলে খেলার মাঠে মেপে পা ফেলে চলতে তিনি খুব ভালোবাসেন। তিনি জানেন শুধু সংখ্যালঘু ভোট নয় এইবার একটু ওই হিন্দুত্ব হিন্দুত্ব বলে যাঁরা চিৎকার করে ভোট চায়, যাঁরা রাজ্যে হিন্দুরা বিপদে আছে, খুব বিপন্ন বলে আওয়াজ তোলে। ঠিক তাদের মুখে জবাব দিতেই এই লাঠি হাতে নেমে পড়লেন তিনি হাসিমুখে মঞ্চে। ডান্ডিয়া নেচে কাছে টানলেন বাকি ওই নন বাঙালি হিন্দুদের। যাঁদের এতদিন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল একমাত্র তাদের সম্পত্তি বলেই দাবি করতেন। কিন্তু তাদের এই হোলি অনুষ্ঠান এর আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মাস্টারস্ট্রোক। একবারে বুঝিয়ে দেওয়া বিরোধী দল বিজেপিকে যে তিনিও আজ এই “দোলি” করে কাছে টেনে নিলেন ওই বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষদের। বার্তা দিলেন আমি তোমাদেরই লোক। যেটা ভোটের অংকে খুব জরুরি বিষয়।
আর তাই ওই দূরের নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগার আগেই বিধানসভা ভোটের ঠিক এক বছর আগেই তিনি সেটা বুঝতে পেরে রাজ্যে নতুন এই বাঙালি হিন্দুদের পবিত্র দোল আর নন বাঙালি হিন্দুদের পবিত্র হোলিকে এক সুতোয় মালা গেঁথে তৈরি করলেন এই “দোলি” উৎসব। যাতে আর সামনের ভোটের মরশুমে নির্বিঘ্নে তিনি শিল্ড জয় করতে পারেন হাসিমুখে। জয় মা মাটি মানুষের জয়। জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়।
বিধানসভায় ধুন্ধুমার, ধনধান্যে “দোলি”! …. কেন?
অভিজিৎ বসু।
তেরো মার্চ।