স্নিগ্ধা চৌধুরী
২৫ হাজার ৭৫৩ জন স্বপ্ন দেখা যুবক-যুবতীর ভবিষ্যৎ একঝটকায় মুছে দিল সুপ্রিম কোর্টের এক রায়। বাতিল হয়ে গেল স্কুল সার্ভিস কমিশনের (SSC) ২০১৬ সালের পুরো প্যানেল। কেউ মাটিতে বসে কাঁদছেন, কেউ লজ্জায় নিজেকে আড়াল করছেন সমাজের চোখ থেকে। আর এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর মুখে শুধুই—‘আমরা মানবিক থাকব’।
এই কি তবে মানবিকতা? নাকি ব্যর্থতার পর্দা টেনে দায় এড়ানোর এক সুচারু কৌশল?
শুক্রবার রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের নকলমঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, আমিও তাই বলছি। যোগ্য-বঞ্চিতদের পাশে আছি।” কিন্তু তাঁর গলায় ছিল না কোনো দায় স্বীকারের সুর, ছিল না কোনো আত্মসমালোচনা। বরং বারবার ইঙ্গিত করলেন, সব দোষ SSC-র তথ্যের—সরকার নাকি শুধুই সহানুভূতির বাহক!
কিন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণ বলছে ভিন্ন কথা। ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট, SSC ‘টেইন্টেড’ ও ‘আনটেইন্টেড’দের তালিকা তৈরি করতে পারেনি। তবে প্রশ্ন একটাই—SSC তো রাজ্য সরকারের অধীনস্থ সংস্থা, তাহলে নজরদারি কোথায় ছিল? আর আজ যখন হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন, তখন কেবল “আমরা পাশে আছি” বলেই কি দায় সারা যায়?
মুখ্যমন্ত্রী নিজেও রায়ের বিরুদ্ধে মানবিকতার যুক্তি খুঁজে বললেন, এই রায় মেনে নিতে পারছি না। যদিও তিনি বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্মান রেখেছেন, কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়াও যেন এক মর্মান্তিক রোমাঞ্চ।
হাইকোর্টে যখন বিচারপতি দেবাংশু বসাকের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চে আল্লার সোনালী দিনের পর দিন চলেছে তখন বহুবার যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথকীকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি বসাক নিজেই। তখন আইনজীবী পাত্র বারবার সময় চেয়েছিলেন। এসএসসি চেয়ারম্যান চিরঞ্জিত ভট্টাচার্যকে হাইকোর্টে তলব করা হয়েছিল। হাইকোর্টের কাছে যোগ্য ও অযোগ্যের পৃথকীকরণের বিষয়টি নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কিছুই করতে পারেনি এসএসসি। এমনকি মামলা চলাকালীন নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি যে মামলা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ssc আইনজীবী সুতনু বাবু। সপ্তাহখানেক মামলা থেকে দূরে থাকার পর ফের যখন হাইকোর্ট কড়া ভাবে এসএসসি কে তাদের কাজ নিয়ে সমালোচনা করে এবং বারবার এসএসসি চেয়ারম্যান কে সমন পাঠায় আদালতে হাজির সুতনু পাত্র। যদিও আদালতের মধ্যেই একাধিকবার সূতনু বাবুকে এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ কিছুটা বাধ্য হয়েই ২০১৬ সালের এই প্যানেল পুরোপুরি বাতিল করার নির্দেশ দেয়। রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি দেবাংশু বসাক জানিয়েছিলেন,” মোট ১৭ টি ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক এই দুর্নীতি হয়েছে এবং তথ্য প্রমাণ যথেষ্ট না থাকায় আমাদের আর কিছু করার ছিল না।” সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না জানিয়েছেন “এই প্যানেলের কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।” অর্থাৎ এই মামলায় শুরু থেকেই রাজ্য সরকার তথা এসএসসির দায় এড়ানোর চেষ্টা প্রকাশ্যে এসেছিল। গাজিয়াবাদ থেকে সিবিআই যেটুকু তথ্য প্রমাণ জোগাড় করতে পেরেছিল তা হিমুশইলের চুড়ামাত্র। হাইকোর্টে এমনটাই জানিয়ে ছিলেন সিবিআই এর আইনজীবী। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকার যেভাবে মানবিকতার বুলি আওড়াচ্ছেন তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এই মুহূর্তে রাজ্যের শিক্ষা ভবনের করিডোরে বয়ে চলেছে অস্থিরতার হাওয়া, আর সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন—এই যে এতদিন ধরে চলল নিয়োগ নাটক, তার শেষ দৃশ্যে কি শুধুই চোখের জল?
মানবিকতার কথা বলে কি মুছে দেওয়া যায় একটা গোটা প্রজন্মের আশা? নাকি সেটাও এখন এক রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের অংশ?
উত্তর চাইছে রাজ্যবাসী। প্রতিশ্রুতির শব্দে নয়—চায় সাহসী স্বীকারোক্তি।