সুপ্রিম কোর্টের এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে বিচারপতিরা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এবং তার পরিচালক অর্থ পাচারের মামলার তথ্য সম্পর্কিত নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন, তবে তাদের আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়ার কোনো অধিকার নেই যে তারা কীভাবে আদালতে আচরণ করবেন। এ রায়টি সরকারি আইনজীবীদের স্বাধীনতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং বিচারিক কার্যক্রমে তদন্তকারী সংস্থার প্রভাব সীমিত করেছে।
বুধবার, বিচারপতি অভয় ওকা এবং অগাস্টিন জর্জ মসিহ-এর বেঞ্চ দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের এক মানি লন্ডারিং মামলার শুনানিতে এই পর্যবেক্ষণগুলো করেন, যেখানে গ্রেপ্তারকৃত দুই ব্যক্তি, জিশান হায়দার এবং দাউদ নাসিরকে জামিন দেওয়া হয়। বেঞ্চ তাদের দীর্ঘ কারাবাসের বিষয়টি লক্ষ্য করে এবং বিশ্বাস করেছে যে খুব শীঘ্রই বিচার শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এখন প্রশ্ন ওঠে, কেন সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের মন্তব্য করল? এটি আসলে আইন ও বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত এক বড় পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি আইনজীবীদের ওপর বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা চাপের পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, যা কখনও কখনও বিচারিক স্বাধীনতা ও আইনজীবীদের পেশাদারিত্বের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করেছে।
এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করেছে যে, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট তাদের তদন্তের তথ্য সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান করতে পারে, তবে পাবলিক প্রসিকিউটরদের আদালতের সামনে কীভাবে আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিতে পারে না। এটি মূলত আদালতের কর্মকর্তাদের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন এবং একটি শক্তিশালী বার্তা যে বিচারব্যবস্থায় কোনো বাহ্যিক চাপ অথবা প্রভাব কার্যকর হতে পারে না।
বেঞ্চ আরও বলে, “এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা এর পরিচালক পাবলিক প্রসিকিউটরকে আদালতে তার কী করা উচিত সে বিষয়ে কোনো নির্দেশ দিতে পারে না।” এটি তাদের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে, তদন্তকারী সংস্থার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিচারব্যবস্থায় এবং বিশেষত সরকারি আইনজীবীদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ আদালতের স্বচ্ছতা এবং বিচারিক স্বাধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এছাড়াও, বেঞ্চ এই ব্যাপারে আরও বলেন যে, যদি তদন্তের বিলম্বের জন্য ইডির কোনো দোষ না থাকে, তবে পাবলিক প্রসিকিউটরদের জামিন আবেদনের বিরোধিতা করতে বাধা দেয়া উচিত নয়। এর অর্থ হলো, তদন্তকারী সংস্থা বা তার কার্যকলাপ যদি বিচারকার্য বিলম্বিত করে, তবে তার জন্য আদালতের কর্মকর্তারা দায়ী নন। এটি আদালতের কার্যক্রমে কোনো ধরনের অবাঞ্ছিত প্রভাব বা চাপ এড়াতে সাহায্য করবে।
ট্রায়াল কোর্টের আদেশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তারা ট্রায়াল কোর্টের নির্দেশের কঠোরতা তুলে ধরলেও এটি স্বীকার করেছেন যে পাবলিক প্রসিকিউটরদের কাজ অবশ্যই ন্যায়বিচারের পথে থাকতে হবে। কোনও মামলার বিচার বিলম্বিত হলে, এটি আদালতের উচিত যে পাবলিক প্রসিকিউটররা সঠিকভাবে, ন্যায্যভাবে এবং স্বচ্ছভাবে তার অবস্থান তুলে ধরবে।
এ ধরনের রায় আদালতের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াতে সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হবে যে, বিচারিক কার্যক্রমে কোনও ধরনের বাইরের হস্তক্ষেপ বা পক্ষপাতিত্ব বরদাস্ত করা হবে না। এটি সরকারী সংস্থাগুলির জন্যও একটি সংকেত যে, বিচারব্যবস্থা তাদের হাতের পুতুল নয়, এবং তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, বিশেষ করে যখন তা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে সংঘর্ষে আসে।
একই সময়ে, পাবলিক প্রসিকিউটরদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের একান্তভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং আদালতের কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে হবে, যাতে বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে হতে পারে।
এছাড়া, এই রায়টির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বিচারের প্রক্রিয়া স্বাধীন এবং অনুপ্রবেশকারীদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তদন্তকারী সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র তদন্ত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এটি শুধু আইনের শাসন এবং বিচারিক স্বাধীনতার পক্ষে একটি বড় পদক্ষেপ নয়, বরং দেশের জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে তুলবে। এই রায়টির মাধ্যমে আদালত একদিকে যেমন সরকারি আইনজীবীদের স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেছে, তেমনি অন্যদিকে তদন্তকারী সংস্থাগুলির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থায় একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়নিষ্ঠ পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।