সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
আপনি কি উত্তর কলকাতার “গিন্নি মা” কে চেনেন? যদি চিনতে চান তাহলে হাতে একটি ডাব এবং চিনি নিয়ে নিন। আর সোজা চলে যান উত্তর কলকাতার কুমারটুলির কাছে বাগবাজার স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে। হ্যাঁ, আজ থেকে পাঁচ শতাধিক বছরের আগে প্রতিষ্ঠিত এই দেবালয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন “গিন্নি মা”। লোকশ্রুতি এই যে, গিন্নি মায়ের কাছে নিজের বা পরিবারের শুভ কামনায় মানত করলে তা পূরণ হবেই। আর তার জন্য ডাব এবং চিনি দিয়ে গিন্নি মায়ের পুজো দিতে হবে। একটু খটকা লাগছে মনে? আসলে কয়েকশো বছর ধরে এই রীতি মেনেই উত্তর কলকাতার ‘গিন্নি মায়ের’ পূজো হয়ে আসছে। যে দেবালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যেমন পৌরাণিক ঐতিহ্য তেমনি ঐতিহাসিক ভাবেও এই দেবালয়ের যথেষ্ট খ্যাতি। পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ, পরম সাধক শ্রীরামপ্রসাদ সেন, নটসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেন, শোভাবাজার রাজবাড়ির রায় বাহাদুর নবকৃষ্ণ দেব আরো বহু ব্যক্তিত্ব। এই মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। এই দেবালয়ের সঙ্গে যোগ রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এমনকি তৎকালীন ডাকাত দলেরও।
মায়ের বড় অদ্ভুত রূপ। পট্ট বস্ত্র পরিহিতা,আয়তলোচনা। এবং মা যার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি হলেন শ্বেত মহাকাল। মানে সাদা শিব। এবং শিব এখানে দিগম্বর। মায়ের বাঁ পা শিবের বুকে রয়েছে। এই দেবালয়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে পরে আসছি। তার আগে কিছু ঘটনার কথা জানাই আপনাদের।
দক্ষিণেশ্বরে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। প্রতিদিনকার মতো সেদিনও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের সঙ্গে ভক্তি বিষয়ক আলোচনায় মত্ত। এই সময় খবর এলো ঠাকুরের বড় ভক্ত ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঠাকুরের মন বিচলিত হয়ে ওঠে। স্থির করলেন, উত্তর কলকাতার এক মায়ের মন্দিরে তিনি যাবেন। যেমন কথা তেমনি কাজ। পরদিন সকালে গঙ্গা দিয়ে রওনা হলেন। কলুটোলার কেশব চন্দ্র সেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি ধর্ম সংস্কারক। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের একজন পরম ভক্ত। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় রামকৃষ্ণকে নিয়ে এক অসাধারণ আর্টিকেল লিখেছিলেন কেশবচন্দ্র। পরম ভক্তের মঙ্গল কামনায় রামকৃষ্ণ উত্তর কলকাতায় এই সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে এলেন। ভক্তের মঙ্গল কামনায় মায়ের কাছে ডাব এবং চিনি দিয়ে মানত করলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ। আপনাদের এখানে বলে রাখি, এখনো এই প্রথা উত্তর কলকাতার মা সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে রয়েছে। গিন্নি মা এখনো ডাব এবং চিনি দিয়েই পূজিতা। মায়ের মন্দির থেকে সামান্য দূরেই রয়েছে নটসম্রাট গিরিশ ঘোষের বাড়ি। শোনা যায় একবার খুব অসুস্থ হয়ে মায়ের মন্দিরে আরোগ্য কামনা করেন গিরিশ ঘোষ। সেদিনই তিনি সুস্থ হয়ে যান। তারপর থেকে নতুন নাটক রচনা করে প্রথম মায়ের পায়ে নিবেদন করতেন গিরিশ ঘোষ। শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশেই নটসম্রাট নতুন রচনা মায়ের পায়ে সমর্পিত করতেন। সিদ্ধেশ্বরী মাকে তিনি বলতেন উত্তর কলকাতার ‘গিন্নি মা’।
বর্তমানে মা সিদ্ধেশ্বরী পশ্চিমমুখী। কিন্তু মা পশ্চিমমুখী ছিলেন না, ছিলেন উত্তরমুখী। তাহলে দিক পরিবর্তন হলো কি করে? একদিন গঙ্গা দিয়ে রামপ্রসাদ সেন চলেছেন গান করতে করতে। কথিত আছে, মা সিদ্ধেশ্বরীর খুব ইচ্ছা হল রামপ্রসাদের গান শুনবেন। তিনি রামপ্রসাদকে বললেন গান শোনাতে। রামপ্রসাদ বেঁকে বসলেন। মা’কে তিনি বললেন, আমি তোমার কাছে গিয়ে গান শোনাতে পারবো না। তোমার যদি গান শুনতে ইচ্ছা করে তাহলে তুমি আমার দিকে ঘুরে গান শোন। ছেলে বলেছে। মা শুনেছেন। সেদিন থেকেই মা সিদ্ধেশ্বরী উত্তরমুখী থেকে হলেন পশ্চিমমুখী।
এবার আসি মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে। পৌরাণিক মতে,
হিমালয়ে সাধনা করছিলেন সাধক কালিবর। সাধনরত অবস্থায় তার ইষ্ট দেবীর নির্দেশে মায়ের মন্দির তৈরির জন্য দক্ষিণ অভিমুখে রওনা হলেন সাধক। পৌঁছলেন বর্তমান কুমারটুলি অঞ্চলে। এখানে তখন বর্তমান কলকাতার মতো রাস্তাঘাট ছিল না। ছিল ঘন হোগলা পাতার জঙ্গল। ঘন জঙ্গলের মধ্যেই গঙ্গার গা ঘেঁষে বসবাস শুরু করলেন সাধক কালিবর। সঠিক সাল পাওয়া বড়ই কঠিন।আনুমানিক ১৫২২।দৈব নির্দেশে দুই শিষ্যকে নিয়ে মায়ের মূর্তি তৈরি করলেন সাধক। কিন্তু সাধক দেবস্থান নির্ণয় করলেন কিভাবে? তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সাধক দেখলেন একটি গাভী নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দুধ দিচ্ছে। এরপর স্বপ্নাদেশ পেলেন যেখানে যেখানে গাভীটি দুধ দিচ্ছে সেটাই দেবস্থান। বর্তমান মা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির যেখানে অবস্থিত সেটাই তৎকালীন দেবস্থান হিসাবে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সাধক কালিবর। এই মন্দির যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন সামান্য হোগলা পাতার ছাউনি ছিল। পরবর্তী সময়ে মন্দির কংক্রিট হয়। শোনা যায়, মা সিদ্ধেশ্বরীকে কোন এক সময় ডাকাতেরাও পুজো করেছে। এক সময় এই মন্দিরে নরবলি চালু ছিল। নরবলি বর্তমানে নিষিদ্ধ হলেও পশুবলি এখনও চালু আছে। কার্তিকী অমাবস্যা এবং ফলহারিনী কালীপুজোয় এখানে বড় উৎসব হয়। সাধক কালিবরের মন অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। নির্দিষ্ট শিষ্যকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি আবার সাধনার জন্য হিমালয়ে ফিরে যান।