বায়ুদূষণ বর্তমান বিশ্বে অন্যতম বড় পরিবেশগত সমস্যা, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বায়ুতে ক্ষতিকর গ্যাস ও ধুলিকণার উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে, যার ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসজনিত সমস্যা, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চল— সব জায়গাতেই বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই সমস্যার সমাধানে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশ ও সংস্থা একত্রিত হয়ে ২০৪০ সালের মধ্যে বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি অর্ধেক করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ অকালে প্রাণ হারান। শহরাঞ্চলে যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানার নির্গমন, নির্মাণকাজের ধুলো এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে কাঠ ও অন্যান্য জৈব জ্বালানির ব্যবহার এবং বনভূমি ধ্বংসের ফলে বাতাসের গুণমান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
এই সংকট মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন দেশ বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, সবুজায়ন প্রকল্পের প্রসার এবং যানবাহন ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে দূষণ কমানোর চেষ্টা চলছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশ এই বৈশ্বিক উদ্যোগে অংশ নিয়েছে।
ভারত বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দূষিত দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও বেঙ্গালুরুর মতো বড় শহরগুলিতে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকারের তরফে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেমন— ইলেকট্রিক যানবাহন ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো, শিল্পাঞ্চলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করা এবং সবুজায়ন বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বায়ুদূষণ হ্রাস করা সম্ভব হবে না। এছাড়া কৃষি খাতে অবশিষ্ট খড় পোড়ানোও দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারলে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।
বিশ্বজুড়ে এই নতুন উদ্যোগের মূল লক্ষ্য বায়ুদূষণের মাত্রা কমানো, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং পরিবেশবান্ধব নীতি কার্যকর করা। এই পরিকল্পনা সফল হলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনমান উন্নত হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। বিভিন্ন শহরে স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার করে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, যা দূষণের মাত্রা শনাক্ত করতে সাহায্য করছে। এছাড়া বায়ু পরিশোধন যন্ত্রের ব্যবহার, সৌর ও বায়ুশক্তির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি এবং যানবাহনের নির্গমন কমাতে কড়া নিয়ম চালু করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, বরং সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সক্রিয় অংশগ্রহণও জরুরি। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারে উৎসাহিত করা, গাছ লাগানো, শিল্প-কারখানার বর্জ্য কমানো, এবং জ্বালানির অপচয় রোধ করার মতো ছোট ছোট উদ্যোগ দূষণ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ কমানোর এই প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তাহলে তা একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণই পারে আগামী দিনের ভবিষ্যৎকে আরও নিরাপদ করে তুলতে। একটি সুস্থ ও নির্মল পৃথিবীর জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি দূষণমুক্ত পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারে।