অভিজিৎ বসু
আজ রামনবমী রামরাজাতলায় সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। আজ থেকে শুরু হলো রাজা রামের চার মাসের রাজ্যপাট। শোনা যায় আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন এই রামরাজাতলার পুজো। কেউ কেউ বলেন এই মেলার বয়স তিনশো বছরেরও বেশি। স্বয়ং মা সারদা এসেছিলেন এই রামরাজার দর্শনে রামরাজা তলায়। গোটা দেশে একমাত্র এই রামরাজাতলাতেই দেখা যায় ‘গোঁফ ওয়ালা’ রাম কে। আসলে দীর্ঘ বনবাসের পর রাম অযোধ্যায় ফেরেন। সেই রাজা রামই এই জায়গার আরাধ্য দেবতা। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন হলো এই রামরাজাতলা।
হাওড়া জেলার সাঁত্রাগাছির অন্যতম প্রাচীন লৌকিক উৎসব হলো এই রামপুজো। রাজা রামের নামানুসারে এই এলাকার নাম হয়েছে রামরাজাতলা। কথিত আছে সাঁত্রাগাছির জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী রাম-সীতার যুগল মূর্তি দেখেন স্বপ্নে। জমিদার মশাই স্বপ্নাদেশ পান রাম- সীতার যুগল অর্চনার। রাম নবমীর দিন শুরু হয় পুজো ও মেলা। সরস্বতী পুজোর দিন একটি স্থানীয় বাগান থেকে রীতি মেনে মূল কাঠামোর বাঁশটি কাটা হয়। এইদিন রামরাজাতলার রাজা রামের পাশাপাশি শুরু হয় বাকসাড়ার নতুন নবনারী ও পুরনো নবনারী এবং ইছাপুরের দেবী সৌম্য চন্ডীর আরাধনা ও।
জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম রাম পূজা শুরু করেছিলেন। তাঁর মতে, তিনি ভগবান রামের পূজা করার জন্য ঈশ্বরের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন। এর পর তিনি ভগবান রামের বিশাল বারোয়ারি পুজো শুরু করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে সেই পুজোটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছিল রামরাজাতলা। কিন্তু সেই সময়কালে সরস্বতী পূজা এই অঞ্চলে খুব বিখ্যাত ছিল এবং পূর্ববর্তী ৩০০ বছর ধরে গ্রামবাসীরা একই পূজার উপভোগ করত। তাই সরস্বতী পূজার অনুরাগী কিছু গ্রামবাসী সেই সময় রাম পূজার বিরোধিতা করেছিলেন।
পরে এই দুটি দল বহু আলোচনার পরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁচ্ছালেন যে রাম পূজা হবে এবং বিদ্যার দেবী সরস্বতী দেবীকে ভগবান রাম ও সীতার শীর্ষে স্থাপন করতে হবে। সেই দিন থেকেই প্রথা অনুসারে ষষ্ঠী তলার বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কাটা শুরু করেন এবং সরস্বতী পুজোর দিন চৌধুরী পাড়া শিব মন্দিরে সেই বাঁশের প্রথম পুজো শুরু হয়। প্রথম প্রথম পুজোর মেলা তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হত। এরপরে এটি দুই সপ্তাহ এবং পরে এক মাস অবধি চলতে থাকে। এখন রাম পূজা চৈত্র-বৈশাখ মাসের রামনবমীতে শুরু হয় এবং শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এটি বাঙালির দীর্ঘতম সময় ধরে চলা মেলা।
একসময় সাঁত্রাগাছি গ্রামে সরস্বতী পুজো অনেক জাঁকজমক করে করা হত। বলা যেতে পারে এই সাঁত্রাগাছির লৌকিক দেবী ছিলেন মা সরস্বতী। বেতড় বন্দর দিয়ে বেহুলা লক্ষীন্দর কে নিয়ে কলার মান্দাস ভাসিয়েছিলেন এই সরস্বতী নদীতেই। গল্পে শোনা যায় সেই সময়ের সকল ব্রাহ্মণ বাধা দেন সরস্বতী কে ব্যতিরেকে এখানে রামের পুজো করা যাবে না কিছুতেই এই জায়গায়। অনেক আলোচনার পর ঠিক হয় সরস্বতী পুজোর দিনে হবে মূল কাঠামোর বাঁশ কেটে তা পুজো করা হবে। রীতি মেনে আজও স্থানীয় এক বাগান থেকে বাঁশ কাটা হয়। চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে শুরু হয় পুজো। মা সরস্বতীর মূর্তি থাকে রামের একদম উপরে। পুজো ও মেলা চলে চারমাস ধরে। এটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি মেলা ও পুজো। শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার শোভাযাত্রা সহকারে রাম ভাসান যান। আবারও দিন গুনতে শুরু করেন এলাকাবাসী কবে আসবেন রাম তাঁদের কাছে।
রাম,সীতা,শিব,ব্রহ্মা,লক্ষন,ভরত,শত্রুঘ্ন,বীভিষণ,বীরহনুমান, জাম্বুবান, সরস্বতী সহ মোট ২৬ টি দেবদেবী আছেন এখানে। আছেন বামন অবতার এবং সাবিত্রী সত্যবান। এখানে রাম একেবারেই রাজকীয় চেহারায় সপার্ষদ চারমাস বিরাজ করেন এই জায়গায়। এরসঙ্গে রয়েছে জমজমাট মেলা। জিলিপি, বাদাম চাকতি, চিনে বাদাম, পেটাই পরোটা, আলুর চপ, ফুলুরি, সোডা সরবত। আরও কত কি। রোল, চাউমিন, বার্গার স্যান্ডউইচ সর্বস্ব জামানায় আজও এই মেলা একটুকরো খোলা বাতাসের মত। তবে রামরাজাতলার এই প্রাচীন বিখ্যাত ‘গোঁফ ওয়ালা’ রাম দর্শন করতে হলে এই রামরাজাতলায় আসতে হবে আপনাকে। যে রামের পূজো শুরু নিয়েও কয়েকশো বছর আগেও তৈরি হয় বিরোধ। যদিও পরে সেই সব মিটে যায়। আর রামরাজতলার রাম পূজো হয়ে আসছে সেই কবে থেকেই। আর আজ তো রামপুজোর শেষ নেই। জয় শ্রী রাম ধ্বনিতে মুখরিত আকাশ বাতাস।