অভিজিৎ বসু
আজ যে ভাষার আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক নারীর দিন। যে নারীর কথা হয়তো আজ আর এই অক্ষর আন্দোলনের ভীড়ে আমাদের আর মনেই নেই এত বছর পর। ভাষা আন্দোলনের কথা মনে এলেই তো আমাদের সেই আব্দুল আর জব্বারদের কথা মনে পড়ে যায়। সেই ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা মনে পড়ে যায়। যে দিন আমাদের রক্তে মজ্জায় মিশে আছে এতদিন পরেও। যে দিন এলেই মনে পড়ে যায় এই আমরি বাঙলা ভাষার কথা। যে বাঙলা ভাষা নিয়ে আমাদের ছিঁটেফোঁটা গর্ব আজও হয় যতই সে নানা আগ্রাসনে ডুবে যাক। কিন্তু সেই ভাষা দিবস এর আগেই আজকের এই দিনটি যেনো ভুলে না যাই আমরা কোনভাবেই। কারণ আসল ভাষা দিবস তো আজকে এই ১৯ শে মে। ২১ শের আগে ১৯ এর হাতছানি। সব বাঙালির অহঙ্কারের তৃপ্তির দিন আজ। সেই শচীন্দ্রমোহন পাল, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদ দাস, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্হ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, এবং সত্যেন্দ্রকুমার দেব এঁদের সবার আগে যার নাম বরাকের ভাষা শহীদ হিসেবে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন কমলা ভট্টাচার্য। বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ তিনি। যাঁর ভাষার জন্য আত্মবলিদানের মর্মর ধ্বনি ভেসে ওঠে বরাক উপত্যকার প্রতিটা পাতায়। ব্রহ্মপুত্রের মতো আত্মমর্যাদা আর আত্মবিশ্বাসে বাঙালির বাংলা ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্ণ দলিল তৈরির সাহস রেখেছিল বরাক।
কমলা ভট্টাচার্যের জন্য আপামর বাঙালি আমরা গর্বিত।
১৯৬১ র ১৯ শে মে সেদিন শুক্রবার শিলচর রেল স্টেশনে বাংলা ভাষার অধিকারের দাবীতে সত্যাগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের বুলেটে প্রাণ হারান কমলা। মণীশ ঘটক কমলার স্মরণে লিখেছিলেন, নেহরু-ফকরু-চালিহার দল বলে বুলেট না বাংলা/ জান দেবো তবু জবান দেবোনা-করুক না যত হামলা’। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে পুলিশের গুলি মাথায় এফোঁড় ওফোঁড় করে জয়ী হন সেদিন কমলা ভট্টাচার্য্য অনেকটা স্মৃতির অতলে এই কমলার নাম। দেশভাগের পর যখন বাঙালির ভূগোল ঠিকানা সবকিছু বদলে যেতে থাকল তখন পিতৃহীন কমলা ১৯৫০ এ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসেন অসমের শিলচরে। স্বস্তির খোঁজে অসমে এলেও, ধর্মের নিরাপত্তা পেলেও ভাষা হারানোর যন্ত্রনা তাঁর পাঁজরে আঘাত দিল সেই ছোটো বেলায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলন। সমস্ত ভাষা আন্দোলনে হাতে হাত মিলিয়ে অংশ নিয়েছেন অজস্র নারী ভাষা সংগ্রামী। ভাষা সংগ্রামীরা জন্ম দিয়েছেন সংগ্রামের, ভাষা আন্দোলনে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এই পথ কণ্টক জেনেও দোর্দণ্ড শক্তিতে এগিয়ে এসেছেন নিজের মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে। ভাষা আন্দোলনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অজস্র নারী দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু ভাষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গকারী একমাত্র নারী ১৬ বছরের এক কিশোরী। নাম তার কমলা ভট্টাচার্য। যাঁর কথা আজ হয়তো আর আমাদের মনেই নেই এতদিন এত বছর পরেও। ১৯৬১ সালের বরাক উপত্যকায় আন্দোলন কারীদের স্লোগান ছিলো ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না’।
কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৫ সালে তৎকালীন আসাম প্রদেশের সিলেটে। বাবা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে পঞ্চম, কমলা। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছিলেন কমলা। বাবা মারা যাওয়ার পর ভীষণ আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটতে থাকে কমলার পরিবারের। তার জন্মের ২ বছরের সময় দেশভাগ হয়ে গেল। আর দেশভাগের সময় এক গণভোটের মাধ্যমে আসাম প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। কমলারা পড়লেন সিলেটে। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন শুরু হলে তার রেশ সিলেটেও এসে পড়েছিল। তাই একটা সময় দেশ ত্যাগ করে আসামে চলে গেলেন কমলা ও তাঁর পরিবার। আশ্রয় নিলেন আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে। শিলচরে কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে।
শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি হয়েছিল কমলার। বয়স তখন তার মাত্র ৫ বছর। কিন্তু পরিবারের ছিল আর্থিক অনটন। অবশ্য কমলার বড় বোন বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে শিমূলগুড়ি চলে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজো বোন প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। মূলত কমলার পরিবার তার অল্প বেতনে চাকরিরত শিক্ষিকা মেজো বোনের আয়ের উপরই নির্ভরশীল ছিল। একটা সময় স্কুলের পাঠ্যপুস্তক কেনারও ক্ষমতা ছিল না কমলার। একবার কমলা তার বড় বোন বেনু ভট্টাচার্যকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলার পড়াশোনা চলতো মূলত সহপাঠীদের কাছ থেকে ধার করে আনা বইতে। কিন্তু তাও তো একদিনের বেশি রাখা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে পড়ার বিষয়বস্তু তিনি নিজের খাতায় লিখে রাখতেন কমলা।
সাংসারিক টানাটানিতে বেশ কষ্টেই পড়াশোনা চলছিল কমলা ভট্টাচার্যের। সুঁই সুতায় সেলাই করে, পাটি বুনে টানাটানির সংসারে সাহায্য করতেন তিনি। বেশ মেধাবী হওয়ায় দ্রুত রপ্ত করতে পারতেন পড়া। মনযোগী ছাত্রী কমলা অবশেষে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসলেন। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হলো ম্যাট্রিক পরীক্ষা। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ছুটি কয়েক মাস। এই সময়ের মধ্যে টাইপরাইটিং শিখে নেবেন তিনি, এই ছিল তার মনের ইচ্ছা।
১৭ মে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিল কমলার। পরদিন ১৮ মে বেশ ভালোই কাটছিলো কমলার। তখন স্বপ্ন বুনছিল কমলা তাঁর দু চোখে বড়ো হয়ে কাজ পেয়ে সংসারে মাকে সাহায্য করবে। প্রথমে কদিন বেশ ভালোভাবেই কাটবে। ১৮ মে কমলা খবর পেল পরদিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে একটি পিকেটিংয়ের ডাক দেওয়া হয়েছে সেই দিন। বলে রাখা ভালো কমলা স্কুলে থাকা অবস্থাতেই বাংলা ভাষা আন্দোলনের সব খবরই পেতেন সেই সময়। বিশেষ করে ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনের জন্মের সময় তো খবর শুনেছেন স্কুলের এক বান্ধবীর কাছে, সেই বান্ধবীর ভাই বান্ধবীকে বলেছিল। ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির বাঙালিরা সংকল্প দিবসের কথাও উদগ্রীব হয়ে শুনেছিলেন তিনি। পালন করেছিলেন উপবাস অব্দি। ২৪ এপ্রিলের দীর্ঘ পদযাত্রা তাকে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল সেই ছোটো বয়সে। অন্যদিকে সত্যাগ্রহীরা যে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন তাও কমলাকে উৎফুল্ল করেছিল দারুণভাবে সেই ছোটো বয়সে। বিশেষ করে মেজো বোনের কাছে তিনি সবকিছুই বলতেন।
দিনটি ছিলো ১৯ মে। আগের দিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেদিন সকালে কমলা পিকেটিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সকালে সে মেজো বোনের জন্য রাখা শাড়িটা পরে নেন কমলা। কিন্তু তার মেজো বোন মিছিলে যেতে বারণ করলেও সে কথা শোনেননি কমলা। ঠিক এ সময় বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের নেতৃত্বে ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল কমলাদের বাড়িতে আসে কমলাকে নেওয়ার জন্য। কমলার মা তার মেয়ে, নাতিদের ছাড়তে রাজী নন। কারণ তার কানে এসেছে স্টেশনে ঝামেলা চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবেন বলে কমলাসহ মঙ্গলা, বড় বোনের ছেলে বাপ্পা কথা দিলো। কিন্তু কমলার মা অনড়। এর মধ্যে বাকি মেয়েরাও তার মাকে আশ্বস্ত করলে এবং দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবে কথা দিলে সুপ্রবাসিনী দেবী রাজি হলেন দুই মেয়েকে ও ছেলে ও নাতিকে ছাড়তে। এসময় তিনি কমলাকে এক টুকরো কাপড় দেন যদি কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তবে যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারে সে সেই কাপড় দিয়ে। কমলার সাথে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও বড় বোনের ছেলে বাপ্পা। তারা স্টেশনে পৌঁছে দেখে প্ল্যাকার্ড, ব্যানারে ভর্তি স্টেশন। লেখা, জান দেবো তবু জবান দেবো না, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ। এই সময় অবস্থান কর্মসূচিতে এসে দাঁড়ায় কমলাসহ বাকিরা সবাই।
বেলা একটার দিকে কমলার মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজেই গিয়ে হাজির হন রেলস্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে তখন একবার পুলিশে ধরেছিল আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসে কমলা, মায়ের ধূলি ধূসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেয়। এসময় মাকে বুঝিয়ে বলে কিছুই হয়নি, ওরা আরেকটু পর চলে আসছে বাড়িতে।
আসলে সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধান হয়েছিল। যদিও অবস্থানের সময়সূচি ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা, কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ, যার ফলে গণ অবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২টা ৩৫ মিনিটের সময় বিনা প্ররোচনায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে শুরু করে পুলিশ ও রাইফেলস। এসময় এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোট বোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যায়। সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার শুরু করে। এর মধ্যে আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা পলায়নরত জনতার উপর অতর্কিত গুলিবৃষ্টি শুরু করে। মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে তার খুলিতে আঘাত হানে। ঠিক তখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কমলা। ধরাধরি করে তাকে অন্য সব গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শহীদ হন সেই ছোটো মেয়ে কমলা।
কমলার বোন সেদিন আহত হলে মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে কাটিয়েছিলেন। কমলা ভট্টাচার্যের মৃত্যুর কয়েক মাস পর প্রকাশিত হয়েছিল তার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল। সেখানে সে প্রথম বিভাগ পেয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কমলা ভট্টাচার্য।
বাংলা ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন কমলা। ১৯৬১ সালে ১৯ মে আজকের দিনে মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য। মাত্র ১৬ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে যিনি হয়ে গেলেন অমর। বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ততোদিন। কমলা ভট্টাচার্যের ত্যাগ থাকবে চির ভাস্বর হয়ে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কমলা ভট্টাচার্যের প্রতি এই আজকের দিনে।যেখানে এই বাংলা ভাষা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে নানা ধরনের চাপে। তবু সেই প্রাদেশিক চাপ সৃষ্টি করে এই আমার বাঙলা ভাষা বাঙালি জাতির সেই একটি ছোট মেয়ের যে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া জীবন দেওয়া আত্মত্যাগ সেটা ভুলে গেলে চলবে না তো। আজ যে ভাষাদিবসের
আগেই এক প্রথম নারীর ভাষা শহীদের দিন। এই দিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রনাম।