একের পর এক সম্পর্ক, অতীতের ভুল, ভেঙে পড়া আত্মবিশ্বাস, কিংবা দিনের শেষে কী খেয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় আপনি কি কাউকে এমন খোলামেলা লিখতে দেখেছেন? অথবা নিজের কাছের কেউ কি আপনাকে প্রথম আলাপে এতটাই গভীর ব্যক্তিগত গল্প বলে ফেলেছে, যাতে আপনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছেন? আমরা অনেকেই এই আচরণকে বলি ‘ওভারশেয়ারিং’, বেশি বলা, অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সম্পর্ককে ভারী করে তোলা। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন, এসব কথার আড়ালে কেউ নিঃশব্দে ‘ভালোবাসা খুঁজছি’ বলে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে?
সমাজ আমাদের শিখিয়েছে সংযত হতে, গোপনীয়তা বজায় রাখতে, আর কম কথা বলাই যেন পরিণত হওয়ার লক্ষণ। অথচ মনোবিজ্ঞান বলছে অন্য কথা। ওভারশেয়ারিং আসলে একটা মানসিক প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ অবচেতনভাবে নিজের না বলা কথাগুলোর মধ্যে ভালোবাসা, সঙ্গ এবং স্বীকৃতির খোঁজ করে। কেউ হয়তো আপনাকে বলেই ফেলল তার জীবনের ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি, পরিবারের চাপ, কিংবা নিজের ভেতরের শূন্যতার কথা, সবই এক নিঃশব্দ আকুতির প্রকাশ, “আমার কথা শোনো, আমায় বোঝো।”
শৈশবে বারবার যদি বলা হয়, “চুপ করো”, “বাচ্চাদের মত বেশি কথা বলো না”, কিংবা যদি অনুভূতি প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে বড় হয়ে সেই অনুভবগুলো মুখ ফোটার সুযোগ খোঁজে। তখন নতুন কাউকে পেলেই নিজের জীবনের গোপন অধ্যায় খুলে বসে মানুষ, যেন একবারের জন্য হলেও কেউ বুঝে ফেলে তার গভীর ব্যথা। কিছু মানুষ আবার নিজের অস্তিত্বকে বোঝাতে বারবার নিজের গল্প বলে। প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা, প্রতিটি ক্ষতের বিবরণ যেন নিজের জীবনের একটি মানে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।
তবে এই খোলামেলা কথা বলার অভ্যাস অনেক সময় উল্টো ফলও দিতে পারে। নতুন সম্পর্কের শুরুতেই অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য অপর পক্ষকে ক্লান্ত করে তুলতে পারে, তৈরি হতে পারে মানসিক দূরত্ব। আবার কেউ কেউ এটিকে দায়িত্ব এড়ানোর উপায় হিসেবেও দেখতে পারে। সম্পর্কের সৌন্দর্য যেখানে ধীরে ধীরে একজনকে জানার মধ্যে, সেখানে ওভারশেয়ারিং অনেকটা ঝড়ের গতিতে সব কিছু উন্মুক্ত করে দিয়ে সেই সৌন্দর্যকে ম্লান করে তোলে।
তবু এটাও সত্যি, অনেক ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত শেয়ার করাটা নিছক দোষ নয়। বরং এটা হতে পারে সম্পর্কের এক সৎ প্রবেশদ্বার। কারণ, কেউ যখন নিজের গভীর যন্ত্রণার কথা বলে, তখন সে নিজের ভেতরটাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে, আর আপনিও যদি সহানুভূতির চোখে তাকান, তাহলে সম্পর্কটা একটা নতুন মাত্রা পেতে পারে। ওভারশেয়ারিং যেন একটা আত্মজিজ্ঞাসার দরজা, আমি কি শুধু শেয়ার করছি, না কি কারও কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছি?
আসলে মানুষ যখন অনুভব করে, কেউ নেই পাশে, তখন সে কথা দিয়ে একটা সেতু গড়তে চায়। হয়তো কথাগুলো এলোমেলো, হয়তো একটু বেশিই বলা হয়ে যায়, তবু ওগুলো নিছক বাক্য নয়, প্রতিটি শব্দের ভেতর থাকে ভালোবাসা পাওয়ার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা। হয়তো একটু বুঝে নিলে, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে, আপনি হয়ে উঠতে পারেন কারও অন্ধকার জীবনের একটুকরো আলো।
তাই যখন কারও অতিরিক্ত শেয়ারিং আপনার চোখে পড়ে, তখন বিরক্ত না হয়ে একটু সহানুভূতির চোখে তাকান। কারণ, অনেক সময় চুপচাপ থাকা মানুষের চেয়ে, কথা বলা মানুষটাই বেশি একা। আর সেই একাকীত্ব থেকে জন্ম নেয় এমন এক অভ্যাস, যা শব্দের মাধ্যমে চায় একটু আদর, একটু গ্রহণযোগ্যতা। মানুষ তো শেষমেশ মানুষই, শুনতে চায়, “তুমি যেমন, তেমনই ঠিক আছো।”