জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিশ্বজুড়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, শতাব্দীর শেষে হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলের প্রায় ৭৫ শতাংশ বরফ গলে যেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে গেলে, এর প্রভাব পড়বে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও চীন সহ ছয়টি দেশের প্রায় ২০০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনে। বিপদে পড়বে হিমবাহ নির্ভর নদ-নদীর জলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিবেশনীতিতে কোনো বড় পরিবর্তন না আনলে ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের গ্লেশিয়ারগুলোর মাত্র ২৫ শতাংশ টিকে থাকবে। তবে যদি ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তাহলে গ্লোবাল স্কেলে প্রায় ৫৪ শতাংশ বরফ রক্ষা করা সম্ভব হবে। আর হিমালয় অঞ্চলে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বরফ টিকে থাকতে পারে।
হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল তৃতীয় মেরু নামে পরিচিত। কারণ অ্যান্টার্কটিকা ও আর্কটিকের পরেই এখানে পৃথিবীর বৃহত্তম বরফের ভাণ্ডার রয়েছে। এই বরফ থেকে উৎপন্ন নদীগুলো যেমন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধুর ওপর নির্ভর করে এশিয়ার একটি বড় জনগোষ্ঠী। এদিকে হিমবাহ দ্রুত গলে গেলে প্রথমে দেখা দেবে হঠাৎ বন্যার আশঙ্কা, পরে দেখা দেবে দীর্ঘস্থায়ী জলসংকট। শুধু তাই নয়, এই প্রভাব পড়বে কৃষিকাজ, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্যের উপরেও। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে, উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে বাসস্থান হারানোর মতো বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, কেবল হিন্দুকুশ নয়, ককেশাস, ইউরোপের আল্পস, উত্তর আমেরিকার রকিজ এবং আইসল্যান্ডের মতো অঞ্চলেও এই হিমবাহের বিপর্যয় ঘটবে। ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলগুলোর ৮৫-৯০ শতাংশ বরফ গলে যেতে পারে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে বরফ পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এহেন প্রাকৃতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২৯ মে ২০২৫ থেকে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের প্রথম গ্লেশিয়ার সম্মেলন। সম্মেলনে ৫০টিরও বেশি দেশ অংশ নিয়েছে। ৩০টিরও বেশি দেশের মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি উপস্থিত রয়েছেন সেখানে। সম্মেলনে বক্তারা বলেন, হিমবাহ গলে যাওয়া শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এটি এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে।
এদিকে হিমালয়ের হিমবাহ গলনের ইতিমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মে ২০২৫-এ সুইজারল্যান্ডের ব্ল্যাটেন গ্রামে ‘বির্চ গ্লেশিয়ার’ ধসে পড়ার ফলে তুষারধস হয়ে গোটা গ্রাম মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। ভারতেও এমন ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। ২০২৩ সালে সিকিমের সাউথ লোনাক গ্লেশিয়ার ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে হিমবাহ গলে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কাও বাড়ছে। গবেষকরা বলছেন, ২০২৪ সাল ছিল রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। যার কারণে হিমবাহ গলার গতি আরও বেড়েছে। তাই পরিবেশবান্ধব নীতি ও প্রযুক্তির দিকেই এগোতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চরম বিপদের মুখে পড়তে হবে। এর দায় চাপবে মানবজাতির ওপরেই।
