জন্ম থেকেই নেই দুই হাত। নামেও মিল। এ যেন সাক্ষাৎ জগন্নাথ প্রভুই নেমে এসেছেন মর্ত্যলোকে। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের বাসিন্দা জগন্নাথ বাউরী। বিশেষভাবে সক্ষম হলেও সরকারি স্কুলে দিব্যি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করে চলেছেন তিনি। তবে রথযাত্রার দিনটি আসলেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। হাত না থাকায় রথের রশি টানতে পারেন না জগন্নাথবাবু। তা বলে প্রভুর আরাধনায় এক বিন্দু খামতিও রাখেন না তিনি।
আউশগ্রাম ১ ব্লকের বেরেন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলুটি গ্রামে বাড়ি বছর পঁয়তাল্লিশের জগন্নাথ বাউরির। তিনি বাড়ির বড় ছেলে। তাঁর ভাইয়ের নাম বলরাম। জগন্নাথবাবু জানান, জন্মের সময় থেকেই হাত না থাকায় গ্রামবাসীরা তাঁকে প্রভু জগন্নাথদেবের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করে। এমনকি তাঁর বাবা লক্ষণচন্দ্র বাউরি ও মা সুমিত্রা বাউরিও মনে করতেন, প্রভু জগন্নাথ দেবেরই আশীর্বাদধন্য তাঁদের সন্তান। তাই ছোট থেকেই সমস্ত প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে ছেলে যে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন, সে বিশ্বাস বরাবরই ছিল জগন্নাথবাবুর মা-বাবার।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে জগন্নাথবাবু জানান, বাবার হাত ধরেই বেলুটি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাওয়া। বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ভূতনাথ পাল তাঁর বাবাকে বলেছিলেন ছেলের নাম জগন্নাথ রাখতে। প্রধান শিক্ষকের উপদেশ মেনে জগন্নাথ বাউরি হিসেবেই পরিচিতি হয়। পেশায় ক্ষেতমজুর ছিলেন জগন্নাথবাবুর বাবা-মা। স্বল্প আয়ের সংসারে কোনওরকমে দিন গুজরান ছিল। তবে উপাস্য জগন্নাথদেবের প্রতি আস্থা রেখেই ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে আরাধনা করে গিয়েছেন জগন্নাথবাবুরা।
পা ধরে পায়ে পেনসিল গুঁজে দিয়ে বাংলা ও ইংরেজি অক্ষর লেখা শিখিয়ে ছিলেন প্রধান শিক্ষক ভূতনাথ পাল। সেকারণে প্রধান শিক্ষকের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ জগন্নাথ বাউরি। হাজারো কষ্টের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে সাফল্যের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন জগন্নাথবাবু। এরপর বেসিক ট্রেনিং কোর্স করে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পান।
পায়ের আঙুলে চক পেনসিল গুঁজেই বোর্ডে লিখেই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়া বোঝান জগন্নাথবাবু। তা নিয়ে কোনও অবিভাবক বা পড়ুয়া কেউ কোনওদিন আপত্তি তোলেনি। বরং তারা ওইভাবে পড়ানোটা মেনে নিয়েছেন। বিদ্যালয়ের সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরাও সকলে তাদের প্রিয় জগন্নাথ স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্ত্রী লক্ষ্মী, বাবা, মা, ভাই ও বোনকে নিয়ে জগন্নাথের ভরা সংসার।
জ্ঞান হবার পর থেকেই প্রভু জগন্নাথ দেবকে তাঁর আরাধ্য দেবতা বলে মেনে আসছেন জগন্নাথবাবু। সেই কারণে প্রতিবছর রথযাত্রার দিনে প্রভু জগন্নাথদেবের ভক্তিভরে আরাধনা করেন তিনি। শুধু একটাই
আক্ষেপ, প্রভু জগন্নাথ দেবের বড় বক্ত হয়েও দুটি হাত না থাকায় রথের রশি টানতে পারেন না তিনি। আক্ষেপ প্রকাশ করে জগন্নাথবাবু বলেন, অনেক সাধ থাকলেও রথের রশি টানার বাসনা এই জীবনে তাঁর পূরণ হবে না।