সম্রাট সেলিম খানের দুর্গস্থান হিসাবেই পরিচিত সেলিমাবাদ গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে এক ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে মেনেই রথের পরেরদিন এই গ্রামে হয় রথযাত্রা। কিন্তু সেখানেও রয়েছে বৈচিত্র্য। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের এই গ্রামের রথে ব্রাত্য থাকেন প্রভু জগন্নাথদেব ,বলরাম ও সুভদ্রাদেবী। পরিবর্তে এখানকার রথে চড়ে গ্রামে ঘোরেন রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল। ব্যতিক্রমি এই মাহাত্মকে আঁকড়েই রথের পরদিন রথযাত্রা উৎসবে মেতে ওঠেন সেলিমাবাদ গ্রামের হিন্দু ,মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন। সম্প্রীতির মেলবন্ধনে হওয়া সেলিমাবাদ গ্রামের রথের খ্যাতি এখন গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
শুধু রথযাত্রা উৎসব নয়, হিন্দু দেবদেবীর কোন পুজোই পঞ্জিকা উল্লিখিত দিনে হয় না এই সেলিমাবাদ গ্রামে। সবই হয় পঞ্জিকায় উল্লেখ থাকা দিনের পর দিন। সেই রীতি মেনে এই বছরও রথযাত্রা তিথির পরদিন অর্থাৎ আজ শনিবার হয়। একেবারে গোঁসাই মতে গ্রামে হল রথযাত্রার পুজো-পাঠ। তবে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পুজো পাঠ নয়, এদিন পুজিত হলেন শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল।
পুজো শেষে বিকেলে এই দুই দেবতার মুর্তি রথে চাপিয়ে গ্রামের মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। শতাধিক বছর ধরে এই ভাবেই ব্যতিক্রমী রথযাত্রা উৎসহ পালন করে আসছেন সেলিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দারা । সেলিমাবাদ গ্রামটি জামালপুর ১ পঞ্চায়েত এলাকার একটি প্রাচীন জনপদ। কথিত আছে, এককালে সম্রাট সেলিম খান এই গ্রামে আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামটি ‘সেলিমাবাদ’ নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ এই গ্রামে বসবাস করেন।
গ্রামের মাঝামাঝি একটি জায়গায় রয়েছে ‘বাল গোপাল জীউ’ এর প্রাচীন মন্দির। আর সেই মন্দিরেই রথযাত্রা সহ হিন্দুদের অন্য সকল আরাধ্য দেবদেবীর পুজোপাঠ হয়।
সেলিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে কথিত আছে, সম্রাট সেলিম খাঁ বহুকাল পূর্বে আরামবাগ থেকে বর্ধমানের দিকে যাচ্ছিলেন। দামোদরের বাঁধ ধরে যাওয়ার সময়ে তাঁদের গ্রামের ’বাল গোপাল জিউর’ মন্দির সংলগ্ন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে সেলিম খাঁ আশ্রয় নেন। পরে পাকাপাকিভাবে সেখানেই তাঁর ’আস্তানা’ গড়ে তোলেন। সেলিম খানের নাম অনুসারে পরবর্তীকালে গ্রামটি ’সেলিমাবাদ’ গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
জামালপুর থানা এলাকার বাসিন্দা, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব গবেষক পূরবী ঘোষ জানিয়েছেন, “কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে সেলিমাবাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রবাদ রয়েছে,
এই গ্রামের সম্রাট সেলিম খান খালি হাতে বাঘ মেরে ছিলেন“। পূরবী ঘোষ আরও জানান, “ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গিয়েছে ,’শের আফগানকে হত্যা করার পর তাঁর পত্নী মেহেরুন্নিসাকে সেলিমাবাদ গ্রামের দুর্গে এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেলিম খান। পরবর্তীকালে এই মেহেরুন্নিসা পরিচিত হয়েছিলেন নুরজাহান নামে“। একইভাবে সম্রাট হওয়ার পর ’সেলিম খান ’পরিচিত হয়েছিলেন ’সম্রাট জাহাঙ্গীর’ নামে।” বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে পূরবী ঘোষ এও জানান,’পূর্বে সেলিমাবাদ গ্রামে হিন্দু ও জৈন ,এই দুই ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। ’সেলিমাবাদ’ গ্রামটি সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে’ ।
এই সেলিমাবাদ গ্রামে ’বাল গোপাল জীউর’ মন্দির তৈরির পিছনেও রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস। কথিত আছে ,’বহুকাল পূর্বে সেলিমাবাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য ও তার স্ত্রী দয়ালময়ী দাসী। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শক্তিপদ সাঁতরা জানান, ’১৯১৮ সালের পরবর্তী কোনও এক সময়ে সেলিমাবাদ গ্রামে এসে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য। বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য এই গ্রামে নিজের বাড়ির সামনেই মন্দির গড়ে তোলেন। সেই মন্দিরেই তিনি রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহের পুজোপাঠ শুরু করেন। তিথি অনুয়ায়ী গোটা দেশ জুড়ে হওয়া রথ উৎসবের পরের দিন সেলিমাবাদ গ্রামের রথযাত্রা উৎসবের সূচনা দ্বীজবরদাস বৈরাগ্যই করেছিলেন’। সেই প্রথা মেনে আজও রথের পর দিন রথের পুজোপাঠ সম্পন্ন করে আসছেন সেলিমাবাদের ’বাল গোপাল জীউ’ সেবা সমিতি।
শক্তিপদ বাবু এও জানান, “পুরীর রথে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়। কিন্তু তাঁদের গ্রামে রথের পরদিন বাল গোপাল জীউ’ মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের প্রস্তর মূর্তি এবং অষ্টধাতুর গোপাল মূর্তির পুজো হয়। তারপর ভক্তদের প্রসাদ ও ভোগ বিতরণ শেষে বিকালে কাঠের তৈরি প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার রথে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও গোপাল মূর্তি চাপিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দামোদরের ধারের মাসির বাড়িতে। মাসির বাড়িতে যাওয়ার পথে এই গ্রামের রথের রশিতে টান দেন সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষজন“।
গ্রামের বাসিন্দা শেখ ওসমান বলেন, “আমি ছোট বয়স থেকেই দেখে আসছি আমাদের সেলিমাবাদ গ্রামের রথে হিন্দু, মুসলিম সহ সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ আন্তরিকভাবে অংশ নেন।
সেই ছোট বয়স থেকে আজ বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েও আমি আমার গ্রামের রথযাত্রা উৎসবে অংশ নিয়ে আসছি । রথের রশিতে টান দি।ধর্মীয় সম্প্রীতির মেলবন্ধনই সেলিমাবাদ গ্রামের রথযাত্রাকে এক ভিন্ন মাধুর্য্যে পৌঁছে দিয়েছে বলে সেখ ওসমান জানিয়েছেন।
গ্রামের প্রবীণা মায়া সাঁতরা জানান, “শুধুমাত্র রথযাত্রার পুজোপাঠই নয়, দোল, শিবরাত্রি জন্মাষ্টমী, এমনকি রাস উৎসবও ’তিথি’ নির্দিষ্ট দিনে সেলিমাবাদ গ্রামে পালিত হয় না। হয় পরের দিন। বহুকাল থেকেই সেলিমাবাদ গ্রামে এমন রীতি রেওয়াজ মেনেই যাবতীয় পূজা-অর্চনা হয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন মায়াদেবী।