অভিজিৎ বসু
আজ উল্টোরথ। আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। কখনও কালো মেঘ আবার কোনো সময় আকাশে রোদ ঝকমক করছে। এই উল্টোরথে। উল্টো পথে নিজের বাড়ী ফিরবেন প্রভু জগন্নাথ দেব। মাসীর বাড়ী থেকে আজ চলে যাবেন তিনি নিজের ঘরে। এসেছিলেন তিনি নিজের ঘর ছেড়ে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ প্রভুর মাসীর ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যাবার দিন। উল্টোরথ টানার মধ্য দিয়ে এই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় পর্ব শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব শেষ হয়। আবার এক বছরের প্রতীক্ষা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস হলো জগন্নাথ দেব হলেন জগতের নাথ বা অধীশ্বর। জগত হচ্ছে বিশ্ব আর নাথ হচ্ছেন ইশ্বর । তাই জগন্নাথ হচ্ছে জগতের ইশ্বর। তাই তাঁর অনুগ্রহ পেলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়। জীবরূপে তাকে আর জন্ম নিতে হয় না কোনো দিন। এ বিশ্বাস থেকেই রথের ওপর জগন্নাথ দেবের প্রতিমা রেখে রথযাত্রা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। শুধু জগন্নাথ নয় সাথে থাকেন বলরাম আর শুভদ্রাও।
ইউটিউবেও জাজবাত, আপডেট থাকুন আমাদের সঙ্গে
সোজা রথের পরে উল্টো রথে জগন্নাথ দেবকে গুন্ডিচা মন্দির থেকে লীলাচলে জগন্নাথদেবের মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। এর আগে রথ যাত্রার শুরুর দিন লীলাচল থেকে জগন্নাথদেবকে গুন্ডিচা মন্দিরে নেওয়া হয। কথিত আছে সত্যযুগে ইন্দ্রদুম্ন্য রাজার স্ত্রী গুন্ডিচাকে শ্রীকৃষ্ণ সন্তান হিসাবে প্রতিবছর নয় দিন তার কাছে থাকার থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন। আর তাঁর রাখা সেই প্রতিশ্রুতি রাখার জন্যই নাকি রথের শুরুর দিন গুন্ডিচা মন্দির থেকে লীলাচলে জগন্নাথদেবের এই মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। সারা দেশ জুড়ে পালিত হয় উল্টো রথ যাত্রা উৎসব। যা দেখে ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে যায়।
বীরভূম জেলার মোহাম্মদ বাজার ব্লক এর এই পুরাতন গ্রামে রথ যাত্রা উপলক্ষে মেলা বসেছে পুরাতন গ্রামে। আর এই গ্রামের চার কন্যা বের করেছে রথ। যা দেখে মন ভরে যায়।আসলে জগতের নাথের রথকে ওরা কয়েকজন বেশ হাসি মুখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পাকা রাস্তা দিয়ে। একদম সাজিয়ে গুজিয়ে ছোটো ওই রথেই বসে আছেন জগতের নাথ হাসি হাসি মুখে। আর ওরা চারজন কেমন যত্ন করে প্রভুকে রথে বসিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের পড়নে সস্তার ফ্রক জামা। আর খালি পা। মাথায় কোনো রকমে একটা চুলে ক্লিপ আটকানো। কারুর আবার সেটাও জোটেনি ওদের। কিন্তু মুখের নির্মল হাসিটা একদম অকৃত্রিম অমলিন আর কলুষহীন।
বাঁশের টুকরো দিয়ে রথের আদলে তৈরি হয়েছে প্রভু জগন্নাথের ছোটো রথ। যে রথের চাকা তৈরি হয়েছে বাঁশের খুঁটি কেটে গোল করে। আর সেই রথের মুর্তি কেনার পয়সা নেই ওদের। তাই ঘর থেকে জগতের প্রভু জগন্নাথের একটি ছবিকে রথের সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে মহানন্দে রথ টানছে ওরা হাসিমুখে। আর মুখে বলছে জয় জগন্নাথ। সত্যিই তো কি সুন্দর এই ছোটো রথে অধিষ্ঠান করেছেন জগতের নাথ। আর কি সুন্দর এই রথের বাহকেরা। যা দেখে মন প্রাণএকদম ভরে যায়। কোনো আড়ম্বর নেই, হৈ হুল্লোড় নেই, বাজনা নেই, ভীড় নেই। তবু প্রভু ওদের হাত ধরেই পথে বেড়িয়ে পড়েছেন মহানন্দে হাসিমুখে।
যাদের কোনো ভাবনা নেই, চিন্তা নেই। জীবনের হাজারো ঝড় ঝাপটা সামলে চলতে গিয়ে এক পেট খিদে পেলেও কোনো অভাব অভিযোগ নেই ওদের কারুর কাছে। কপাল চাপড়ে হা হুতাশ করে ভগবানের দোহাই দেওয়া নেই। শুধু এটা আছে তারা সকলেই গভীর বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে এই রথের রশিতে টান দিয়েছে তারা একসাথে একমনে। প্রভুকে আপন মনে করে নিজের করে নিয়েছে এই ছোটো কালেই ভালোবেসে। আর তাই বোধহয় কোনো প্রশ্ন নেই ওদের। জগতের প্রভুর কাছে চাওয়া আর পাওয়ার কোনো হিসেব নেই। আর তাই অনুযোগও নেই।
হাসি মুখে সবটা মেনে নিয়ে শুধু রথের রশিতে হাত ছুঁইয়ে পথ চলা আছে। যে পথ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই তাদের। ওদের দেখে মনটা বড়ো ভালো হয়ে গেলো আজ। বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম এই পুরাতন গ্রামের এই ছবি নতুন করে আমার জীবন বোধের শিক্ষা দিলো আমায় আজ এই উল্টো রথের দিন।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
যে ভগবান, জগতের নাথ এর কাছে শুধু চাওয়া আর পাওয়ার সম্পর্ক নয়। সেটার পূরণ না হলে তাঁর প্রতি অভিমান নয়। কপাল আর ভাগ্যের দোহাই নয়। এটাই চেতনা যে প্রভু যেভাবে যেমন করে রাখবেন সেভাবেই আমরা তাঁকে নিয়ে চলবো জীবনের পথে। তাঁর রথের রশিতে হাত দিয়ে এই প্রার্থনা করি আমি।
জীবনের সোজা আর উল্টো পথের মাঝে হাজারো ঝড় ঝাপটা এলেও যেনো থমকে না দাঁড়িয়ে পড়ি বিশ্বাস হারিয়ে। মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত লাইন। রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি। মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসেন অন্তর্যামী। সেই অন্তর্যামী বোধহয় সবার অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। আর সেটা বুঝতে পেরেই ওরা চারজন হাসি মাখা উজ্জ্বল মুখে প্রভুকে আপন করে নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। জয় জগন্নাথ।