কণাদ মুখার্জি
ধরুন একটা পুকুর। পুকুরটার জল উপর থেকে দেখতে ছবির মতো। জলে আসছে আকাশের নীল ছবি। দেখা যাচ্ছে সাদা মেঘ। কিন্তু উপরের এই প্রতিচ্ছবি সরিয়ে পুকুরের জলের যত গভীরে যাচ্ছেন ততই আপনি আবিষ্কার করছেন জলের গভীরতা, ঘূর্ণি। কিন্তু জলের উপর থেকে এর কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই। সরকারি স্কুলের ক্লাসরুমের ফার্স্ট বেঞ্চ ও লাস্ট বেঞ্চের মধ্যে দৃশ্যত ফারাক এমনটাই।
তিরুঅনন্তপুরমের কারেট্টুর কেআর নারায়ণন মেমোরিয়াল আপার প্রাইমারি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির সি সেকশনের এমনই এক ক্লাসরুমের গল্প নিজের ছায়াছবি ‘স্থানার্থী শ্রীকুত্তান’-এ তুলে ধরেছেন মালয়ালাম পরিচালক ভিনেশ বিশ্বনাথ।ক্লাসরুম মানেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, শিক্ষকশিক্ষিকা বা ব্ল্যাকবোর্ডের সঙ্গে পড়ুয়াদের সমকৌণিক দূরত্ব। শিক্ষাবিদদের একাংশের মতে, এই সমকৌণিক দূরত্ব থেকেই তৈরি হয়েছে বিষম বিপদ। তৈরি হয়েছে ফার্স্ট বেঞ্চ ও লাস্ট বেঞ্চের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। ‘স্থানার্থী শ্রীকুত্তান’ ছায়াছবিতে ক্লাসরুম থেকে এ হেন ব্যাকবেঞ্চকেই লোপাট করে দিয়েছেন বিনেশ। তাঁর তৈরি ক্লাসরুমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে পড়ুয়াদের কৌণিক দূরত্ব ১৮০ ডিগ্রি। ক্লাসে না আছে ফার্স্টবেঞ্চ, না আছে লাস্টবেঞ্চ। এখানে সবাই রাজা।

এই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটেছে দেশের কোনও কোনও স্কুলে। সেই ছবি দেখা গিয়েছে এ রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা-২ ব্লকের ঝিকরা রাহমানিয়া এফপি স্কুল, বর্ধমান-১ ব্লকের বেলকাশ এফপি স্কুল, কেতুগ্রামের রাজুর বান্ধব হাইস্কুলেও। ক্লাসরুমে ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো সাজানো বেঞ্চ। শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রশাসনিক কর্তা বা অভিভাবকদের একাংশের ধারণা, এতে করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। পড়ুয়ার গা থেকে খসে পড়বে ব্যাকবেঞ্চার তকমা। সকলের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার অভিযানে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আমাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে দেবে। যেমন ভাবে স্কুল শিক্ষাব্যবস্থাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে নম্বরের বদলে গ্রেডেশন প্রথা চালু করা।
কিন্তু এটাও ঠিক, ক্লাসরুমের বেঞ্চ সাজানোর ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন করে সারা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের পরিস্থিতিটা রাতারাতি বদলে ফেলা যাবে না। পিআইবির রিপোর্ট বলছে, এখনও এই দেশের প্রায় ২৫ কোটি ছাত্রছাত্রী সারা দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ স্কুলে পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে ১৪ কোটির কিছু বেশি পড়ুয়া পড়াশোনা করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। এ রাজ্যের ৯০ শতাংশ পড়ুয়া সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। বেসরকারি স্কুলের রমরমার বেশিরভাগটাই কলকাতা ও মফস্্সল কেন্দ্রিক। বেশিরভাগেরই ভরসা সরকারি স্কুলের উপর।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
কিন্তু সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের একাংশ এখনও প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। অনেকের পঠনপাঠন নির্ভর করে কখন চাষবাস হবে না তার উপর। কারণ চাষবাস শুরু হলে অনেক সময়েই পরিবারকে সাহায্য করতে স্কুল কামাই করতে হয় পড়ুয়াকে। করোনা নিয়ন্ত্রণে নরেন্দ্র মোদির সরকার লকড়াউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার পর, স্কুল খুললে দেখা যায়, বহু ছাত্রছাত্রীই অনুপস্থিত। কারণ, তাদের অনেকেই পরিবারের খিদে মেটাতে পড়া ছেড়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল কাজের খোঁজে। সেই পরিস্থিতি যে কেটে গিয়েছে এমন নয়।
স্কুলে সকলে সমান। শিক্ষাঙ্গনে ধর্ম বা জাতপাতের শ্রেণি বিভাজন নেই। সেই ভাবনা থেকেই স্কুলে ইউনিফর্মের প্রচলন। এখন তো এ রাজ্যের সরকারি ও সরকার অনুমোদিত স্কুলে পড়ুয়াদের সাইকেলের পাশাপাশি দেওয়া হয় ইউনিফর্ম ও জুতোও। কিন্তু ক্লাসরুমের পঠনপাঠনেই যে ছাত্রছাত্রীরা সকলে দড় হয়ে উঠছে এমন নয়। ফলে প্রচলন হয়েছে প্রাইভেট টিউশন বা কোচিং ক্লাসের। কিন্তু বাড়তি টাকা খরচ করে সেই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ নেই অনেক শিক্ষার্থীরই।
আরও পড়ুন
ক্লাস রুমে পর পর বেঞ্চ সাজানোর প্রথা দীর্ঘকালের। সেই ব্যবস্থাও তৈরি হয়েছিল নির্দিষ্ট বিজ্ঞান মেনেই। শিক্ষকদের একাংশ বলছেন, ইংরেজি ইউ অক্ষরের আকারে বেঞ্চ সাজিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে বসানোর পদ্ধতি একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাঁদের মতে, এতে অনেকের ব্ল্যাকবোর্ড দেখতে অসুবিধা হবে। দূরের দিকের ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো শুনতে পাবে না। পাশাপাশি, গরমে পাখার হাওয়াও সকলের গায়ে লাগবে না। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি হলে এমন ভাবে কয়েকটি মাত্র বেঞ্চ সাজালে বাকি ছাত্রছাত্রীরা কোথায় বসবে, সেই প্রশ্নও তুলছেন শিক্ষকদের একাংশ। লাগাতার ঘাড় ঘুরিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখতে হলে ভবিষতে ঘাড়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা অনেকের।

‘ব্যাকবেঞ্চার’ শব্দটির উৎপত্তি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে। কিন্তু শব্দটির অর্থ বহুমুখী। ‘ব্যাকবেঞ্চার’ মানে শুধু পিছনের বেঞ্চে মুখ লুকিয়ে থাকাদের দল নয়, এর অর্থ আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়াও বটে। ক্লাসরুমে ইংরেজির ইউ অক্ষরের আকারে বেঞ্চবিন্যাস করে আক্ষরিক অর্থে ব্যাকবেঞ্চারদের কিছুটা সুবিধা না হয় করে দেওয়া গেল। কিন্তু যারা আর্থসামাজিক ভাবে ব্যাকবেঞ্চার তারা কি সত্যিই সার্বিক ভাবে এগিয়ে যেতে পারবে এই নয়া বিন্যাস কৌশলে? ফলে ব্যাকবেঞ্চারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর এই কৌশল আপাতত বাহ্যিক পরিবর্তন বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, সকল পড়ুয়ার হাতে বই তুলে দেওয়ার পাশাপাশি, তাদের লেখাপড়া শেখার পরিবেশও ভালভাবে তৈরি করে দেওয়া প্রয়োজন। যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে অর্থনীতির সুষ্ঠু বিন্যাস।
