স্নিগ্ধা চৌধুরী
শরতের আকাশে সূর্যের প্রথম রোদ যেন সোনার কোল, মাঠঘাটে কাশফুলের ঢেউ বেয়ে যেন স্বর্গের সুবাস ভেসে আসে। বাতাসে এক অদৃশ্য সুর যেন প্রাচীনকাল থেকে বেঁচে থাকা দেবীর আহ্বান। রাত পোহালেই মহালয়া। ভোরের অন্ধকারে ভেসে আসে সেই কণ্ঠস্বর, যা বাঙালির হৃদয়ে ঢেউ তোলে, প্রাণে এক অমোঘ প্রতিধ্বনি জাগায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর মহাকাব্যিক কাহিনি। প্রতিটি শব্দ যেন সময়ের আবরণ ছিঁড়ে চলে আসে, যেখানে স্বর্গের দেবতা, মৃত্যুর যমরাজ, পিতৃলোকের আত্মা এবং মহিষাসুর সবই এক মহাজগতে মিলিত হয়।
পুরাণমতে, মহালয়ার দিনে পিতৃপক্ষ শেষ হয়। পূর্বপুরুষদের আত্মা মর্ত্যে নেমে আসে, নদীর ঘাটে পবিত্র জল ছুঁয়ে যায়। পিতৃলোকের শান্তি কামনায় করা পিণ্ডদান, স্নান এবং কাশফুলে ভরা ঘাট সব মিলিয়ে এক আধ্যাত্মিক সমাহার। তবে এই দিন শুধু পিতৃপুরুষদের নয়, দেবী দুর্গাকেও মর্ত্যে আহ্বান জানানো হয়। স্বর্গের দেবতারা মহিষাসুরবধের জন্য দেবীকে আহ্বান করেছিলেন। সেই আহ্বান বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়।
মহিষাসুর, অশুভের এক প্রতীক, যার দেহে অন্ধকারের অজস্র শক্তি সঞ্চিত। সে আকাশ-নাভি কাঁপিয়ে হেসে উঠে। স্বর্গের দেবতারা, যাদের হাতে অসীম জ্যোতি-শক্তি, বীরত্ব এবং দ্যুতিময় আলো, তাঁরা মহালয়ার ভোরে দেবীকে ডাকেন। তখন দেবী দুর্গা শক্তির অবতার, করুণা ও ন্যায়বোধে পূর্ণ মহিষাসুরের সামনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, তাঁর ত্রিশূল দিয়ে অশুভের শক্তিকে বিনাশ করেন।
এই মহাকাব্যিক কাহিনি আকাশবাণীতে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের রচনায়। তিনি মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর কাহিনিকে চম্পুর আকারে তৈরি করেছিলেন, যেখানে গদ্য ও পদ্য মিলিত হয়ে এক জীবন্ত কাহিনি রচনা করে। প্রথমবার বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে এটি আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়। এরপর দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীতে অনুষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয়, এবং ১৯৩২ সাল থেকে মহালয়ার ভোরে টানা চলতে থাকে। একবার ১৯৭৬ সালে উত্তম কুমারের কণ্ঠে প্রচার করার চেষ্টা করা হলেও শ্রোতাদের বিক্ষোভে পুনরায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহালয়া পাঠ শোনা হয়। আজও তাঁর অমোঘ কণ্ঠে প্রতিটি মহালয়ার ভোরে সেই মহিমা বাঙালির ঘরে ঢুকে যায়।
মহালয়া শুধু অনুষ্ঠান নয়, এটি দেবীপক্ষের দোরগোড়া, ইতিহাসের সাক্ষী, বিশ্বাসের প্রতীক এবং আধ্যাত্মিকতার এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। নদীর ঘাটে তর্পণ, কাশফুলের ঢেউ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের সুর সব মিলিয়ে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে এক দেবময় রূপ আঁকে। পিতৃলোকের শান্তি, মহিষাসুরের ভয়ঙ্কর রূপ, স্বর্গের দেবতার আহ্বান, আর দেবী দুর্গার করুণা সব মিলিয়ে এই ভোরকে পরিপূর্ণ করে।
মহালয়া মানে এক দেবময় ভোর, যেখানে জীবন, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা সব একত্রিত হয়ে এক মহাকাব্যিক দৃশ্য অঙ্কিত করে। প্রতিটি বাঙালি ঘুম থেকে উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর কাহিনি শুনে আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়, প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়, আর দেবীর উপস্থিতি অনুভব করে। কাশফুলের সুবাস, নদীর পবিত্র জল, বেতারের ভোর, প্রতিটি শব্দ, সব মিলিয়ে মহালয়া বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
মহালয়া মানে শুধুই উৎসব নয়, এটি এক দেবময় যাত্রা, যা প্রতিটি মহালয়ার ভোরে নতুন করে জাগ্রত হয়, প্রতিটি হৃদয়কে শক্তি, পুণ্য ও দেবীর করুণায় ভরিয়ে দেয়। মহালয়া মানে মহিষাসুরের বধ, স্বর্গের আহ্বান, পিতৃলোকের শান্তি, এবং দেবীপক্ষের দ্যুতিময় যাত্রা, সব মিলিয়ে এক অনন্ত আধ্যাত্মিক কাব্য।