স্নিগ্ধা চৌধুরী
নবরাত্রির পবিত্র নবরূপে চতুর্থ রূপের আবির্ভাব দেবী কুষ্মাণ্ডা। মহাশক্তির এই রূপ কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক রহস্য নয়, বরং সৃষ্টির আদি আখ্যানের অন্তর্লীন শক্তি। যখন প্রলয়ের পর বিশ্বজুড়ে ছিল কেবলই ঘন অন্ধকার, তখন একমাত্র দেবী কুষ্মাণ্ডাই সূক্ষ্ম হাসিতে ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তাঁর নাম কুষ্মাণ্ডা, অর্থাৎ যিনি ক্ষুদ্র কুম্ভের মতো সূক্ষ্ম জ্যোতির্কণা থেকে বিশাল বিশ্বকে নির্মাণ করেন।
কু’ শব্দের অর্থ কুৎসিত এবং ‘উষ্মা’ শব্দের অর্থ ‘তাপ’; ‘কুষ্মা’ শব্দের অর্থ তাই ত্রিতাপ বা দুঃখ। দেবী জগতের দুঃখ গ্রাস করে নিজের উদরে ধারণ করেন, তাই তার নাম ‘কুষ্মাণ্ডা’। তিনি জগৎকে ধারণ করেন, মানুষের আধ্যাত্মিক, দৈহিক, সব ত্রিতাপ গ্রাস করে নিজের অন্তরে ধরে রাখেন। এভাবেই তিনি দুঃখের অবসান ঘটিয়ে মর্ত্যে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির আলো জ্বালান।
দেবী কুষ্মাণ্ডা অষ্টভুজা। তাঁর আটটি দিক জুড়ে ছড়িয়ে আছে শস্ত্র ও শক্তির প্রতীক। হাতে থাকে সুদর্শনচক্র, ধনুক-বাণ, রক্তপদ্ম, অমৃতকলস, কমণ্ডলু, জপমালা ও আরও নানা ঐশ্বর্যচিহ্ন। এই সবই শক্তি ও সৃষ্টির চক্রকে প্রতিফলিত করে। তাঁর ত্রিনয়ন যেন সূর্য, চন্দ্র আর অগ্নির মিলিত দীপ্তি। বাহন সিংহ অদম্য সাহস ও শক্তির প্রতীক।
পুরাণে বলা হয়েছে, দেবী কুষ্মাণ্ডা কাশীর দক্ষিণ দিকে অধিষ্ঠিত। অসি নদীর সঙ্গমস্থলে তাঁর স্থান, যেখানে তিনি দুর্গা নামেই পূজিতা। কাশীর রক্ষয়িত্রী তিনি, নগরীর দক্ষিণ প্রান্তে অগ্নির মতো বিরাজমান। তাই আজও কাশীতে দেবী কুষ্মাণ্ডার মন্দির ভক্তদের কাছে অতুলনীয় পবিত্র স্থান।
শাস্ত্র মতে, তাঁর আরাধনায় ভক্ত অর্জন করে বৈভব, সুখ, যশ এবং অক্ষয় সমৃদ্ধি। বলা হয়, অল্প পূজাতেই তিনি সন্তুষ্ট হন। তাঁর উপাসনায় কুমড়ো বলি দেওয়ার প্রথা আজও প্রচলিত। কুমড়ো অর্থাৎ ‘কুষ্মাণ্ড’, যা অর্ঘ্য হিসেবে দেবীর কাছে সমর্পিত হয়।
পুজোর নিয়মে বলা হয়েছে, প্রথমে কলস স্থাপন করে দেবতাদের আহ্বান করতে হবে। তারপর ধূপ, লাল ফুল, সাদা ফল নিবেদন করতে হবে দেবীর চরণে। বিশেষ করে ভোরে স্নান করে পবিত্র মনে ফুল হাতে ধ্যান করলে দেবী ভক্তকে আশীর্বাদে অভিষিক্ত করেন। তাঁর প্রিয় ভোগ হালুয়া আর দই যা ভক্তরা প্রসাদ রূপে গ্রহণ করেন।
দেবী কুষ্মাণ্ডার উপাসনা কেবল বাহ্যিক পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর রূপে নিহিত আছে এক চিরন্তন শিক্ষা- অন্ধকার থেকে আলো, শূন্য থেকে সৃষ্টি, দুঃখ থেকে মুক্তি। তিনি বিশ্বজননী, যিনি একটিমাত্র দ্যুতিময় হাসিতে মহাশূন্য ভেদ করে সূর্যকান্তি প্রজ্বলিত করেন।
ভক্তির দৃষ্টিতে দেবী কুষ্মাণ্ডা মানে অগ্নিজ্যোতি, যিনি জীবনের অন্ধকার সরিয়ে দেন। যাঁর করুণা মানুষকে সুখ, সৌভাগ্য ও ধন-সম্পদে পূর্ণ করে। তাই নবরাত্রির চতুর্থ দিনে ভক্তরা পূর্ণ ভক্তি ও নিষ্ঠায় তাঁকে আহ্বান করেন।
এইভাবেই দেবী কুষ্মাণ্ডা কেবল দেবীর এক রূপ নন, বরং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের জন্মদাত্রী শক্তি, যিনি অন্ধকার ভেদ করে জীবনের প্রতিটি স্তরে আলো ছড়িয়ে দেন। নবরাত্রির চতুর্থ দিনে তাই সমগ্র ভক্তসমাজ তাঁর ধ্যানে নিমগ্ন হয়, কারণ তাঁর শক্তি মানেই সৃষ্টির আদি আলো।