
বিশ্বদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছট পুজো আসলে আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, লাতিন আমেরিকার ইনকা সভ্যতার মতো সূর্য উপাসনার রীতি এদেশেও সুপ্রাচীন। ঋগ্বেদে সূর্য এবং তাঁর পত্নী ঊষাকে অন্যতম প্রধান দেবদেবীর স্থান দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সূর্যকে মনে করা হয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের উৎস। তাই জীবনের ধারা অব্যাহত রাখতেই চৈত্র এবং কার্তিক মাসের (মূল এটাই) শুক্লাষষ্ঠীতে নানারকম ফল, ঠেকুয়া, পায়েস ইত্যাদি নিবেদন সহকারে ‘সূর্য-ষষ্ঠী’ ব্রত পালন করেন মূলত উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মানুষজন। এই ষষ্ঠী অপভ্রংশে ‘ছট্’ বা ‘ছঠ্’ হয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই ‘ছটে’র সূত্রপাত নিয়েও নানান পৌরাণিক উপাখ্যানের উদ্ভব ঘটেছে। ‘রামায়ণ’ অনুযায়ী, ১৪ বছরের বনবাস শেষে এই দিনই অযোধ্যায় ফেরেন শ্রীরামচন্দ্র। এর পর তিনি কুলদেবতা সূর্যকে আরাধনা করেন। অন্যদিকে, ‘মহাভারতে’র আবার চারটি বক্তব্য। যথা—
(১) সূর্যের উপাসনা করে কুন্তীর কর্ণকে জন্ম দেওয়া থেকেই ছট্ ব্রতের সূচনা।
(২) বনবাসকালে কুলপুরোহিত ধৌম্যের কথায় সূর্যের পূজা করে দ্রৌপদী ‘অক্ষয়পাত্র’ লাভ করেছিলেন।
(৩) কর্ণ নদীতে কোমর পর্যন্ত নেমে সূর্যের উপাসনা করতেন, সে কারণে আজও ‘ছটে’ কোমর-জলে নেমেই সূর্যের পুজো করতে হয়।
(৪) পান্ডু কিমিন্দম মুনিকে সঙ্গমরত অবস্থায় হত্যা করে শাপপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে সঙ্গমকালে তাঁরও মৃত্যু ঘটবে, তাই তিনি সন্তানলাভের আশায় স্ত্রী কুন্তীর সাথে সরস্বতী নদীর তীরে সূর্য বন্দনা করেছিলেন।
‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ অনুসারে, সৃষ্টির দেবী নিজেকে ছয় ভাগে ভাগ করেছিলেন। ষষ্ঠ রূপটি মাতৃরূপ। একটি কাহিনী থেকে জানা যায়, প্রথম মনু প্রিয়বত সন্তানহীন হওয়ায় পিতা কাশ্যপের পরামর্শে ‘পুত্রীয়েষ্টি যজ্ঞ’ করালেন। এতে একটি ছেলে জন্মায় ঠিকই কিন্তু মৃত অবস্থায়। তখন আকাশে এক দেবী আবির্ভূতা হয়ে জানালেন, তাঁর নাম ষষ্ঠী এবং তিনি সমস্ত শিশুর রক্ষা করেন। এই বলে তিনি মৃত পুত্রটিকে স্পর্শ করতেই সে বেঁচে ওঠে। ধারণা করা হয়, ইনিই সূর্য-ঘরণী ঊষা।
মতান্তরে, ষষ্ঠী বা ছট্ সূর্যের স্ত্রী নন, বরং ভগিনী। যিনি আসলে পার্বতীপুত্র কার্তিকেয়র স্ত্রী। তাঁর অপর নাম দেবসেনা। তাঁকে তুষ্ট করতেই সূর্যকে আরাধনা করা হয়। এ ছাড়া, বেদমাতা গায়েত্রীদেবীর জন্ম, মনে করা হয়, ষষ্ঠী এবং সপ্তমীর মধ্যবর্তী সময়ে। ইনিই ষষ্ঠীদেবী হতে সৃষ্ট সকল শিশুকে রক্ষার দায়িত্বে থাকেন।
সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, নানা মুনির নানা মত। ষষ্ঠী বা ছট্ সন্তান উৎপাদনের দেবী, ওদিকে সূর্যও জীবনের উৎস, এই সাদৃশ্যটা একটু বেশিই যেন চোখে লাগে। অবশ্য সে জন্য ছট সংক্রান্ত বাকি ধারণাগুলি উপেক্ষা করার উপায় কোথায়? স্থান-কালের নিরিখে প্রতিটিই অকাট্য। ঋগ্বেদের পাশাপাশি ‘ছটে’র প্রত্যক্ষ উল্লেখ ‘অথর্ব বেদে’ও রয়েছে। এই ব্রতের মূল দিন ষষ্ঠী হলেও চতুর্থী থেকে সপ্তমী— টানা চারদিনই লবণবিহীন খাবার খেয়ে, এবং কখনো নিরম্বু উপবাস থেকে ব্রতটি করতে হয়।
