খাবারের প্রতি বাঙালির প্রেম বহুদিনের। এখানে খাবার মানেই কবিতা, স্মৃতি আর ফুরফুরে মেজাজ। বর্ষা নামলেই সেই খাবারে আসে অন্য ছন্দ। গরমের দাবদাহ কেটে গিয়ে শীতল বৃষ্টিতে বদলে যায় রান্নাঘরের উপকরণ, রান্নার ধরন আর খাওয়ার ইচ্ছে। বহুমুখী আর দুর্দান্ত স্বাদের রান্নাবান্নার জন্য বিখ্যাত বাঙালির রান্না বর্ষাকালে নতুন মাত্রা পায়। কখনও হালকা সহজপাচ্য খাবার, আবার কখনও খাস্তা বা ভাজা জাতীয় খাবার। প্রতিটি পদে যেন ফুটে ওঠে বাঙালির বাইরের আবহাওয়া আর ভেতরের অনুভূতি।
বর্ষা এলেই বাজারে ভিড় জমায় রংবেরঙের কাঁচা শাক সবজি। তালিকায় থাকে বেগুন, কুমড়ো, কাকরোল, পুঁই শাক, কলমি শাক, ঝিঙে, চালকুমড়ো ইত্যাদি। আর মাছের মধ্যে আসে ইলিশ। এই সময়ে খাবার যেমন হয় পেটের জন্য হালকা, তেমনই স্বাদে সমৃদ্ধ। বৃষ্টি ভেজা দুপুরে এক বাটি খিচুড়ি কিংবা উৎসবের প্লেটে সর্ষে ইলিশ, সবেতেই মিশে থাকে ঐতিহ্য আর ঋতুর ছোঁয়া।
তাহলে বৃষ্টি নামলে বাঙালির পাতে কী থাকে? দেখে নিন বর্ষার ৬টি খাসা খাবার
১. ভুনা খিচুড়ি: বৃষ্টির দুপুরের সঙ্গী ভুনা খিচুড়ি। গোবিন্দভোগ চাল, ভাজা মুগ ডাল, ঘি আর গোটা মশলা দিয়ে তৈরি হয় ভুনা খিচুড়ি। এটা সাধারণ খিচুড়ির চেয়ে অনেক বেশি সুগন্ধি আর রিচ।সাধারণ খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ির পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ খিচুড়ি হয় হালকা ও পাতলা, প্রায়শই অসুস্থ হলে বা দৈনন্দিন খাওয়ার জন্য বানানো হয়। আর ভুনা খিচুড়িতে আগে মুগ ডাল শুকনো ভেজে নেওয়া হয়। চাল ঘি-তে ভেজে নেওয়া হয় মশলার সঙ্গে। তাই এর গন্ধ আর স্বাদ হয় একেবারে দুর্দান্ত। বেগুন ভাজা, পাপড়, ইলিশ ভাজা, চাটনি সবকিছুর সঙ্গে ভুনা খিচুড়ি দারুন জমে।
২. বেগুন ভাজা: খিচুড়ির শ্রেষ্ঠ সঙ্গী বেগুন ভাজা। খিচুড়ির সঙ্গে গরম গরম বেগুন ভাজার জুড়ি নেই। মোটা স্লাইস কেটে হলুদ-লবণ মেখে সোনালি করে ভাজা হয়। বাইরে খাস্তা আর ভেতরে নরম।
মাছপ্রেমীদের জন্য টিপস: বেগুনের জায়গায় এক টুকরো ইলিশ মাছ ভেজেও খাওয়া যায়।
৩. সর্ষে ইলিশ: বর্ষার রানি ইলিশ। ইলিশ মাছকে সর্ষের পেস্ট, কাঁচালঙ্কা আর সর্ষের তেলে রান্না করা হয়। এর স্বাদে আছে বাঙালির আলাদাই আহ্লাদ। কেন ইলিশ বর্ষায় খাওয়া হয় জানেন?
ইলিশ বর্ষায় ডিম পাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে নদীতে আসে। এই সময়েই মাছ হয় সবচেয়ে তেলতেলে, নরম আর সুগন্ধি।
রান্নার টিপস: সর্ষে বাটা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে পাতলা ঝোল বানান। ইলিশ মাছকে বেশি না রান্না করে হালকা আঁচে সেদ্ধ করুন। তাহলেই পাবেন আসল স্বাদ।
৪. তালের বড়া: পাকা তাল, নারকেল, গমের আটা, চালের গুঁড়ো আর গুড় দিয়ে বানানো এই বড়া খেতে হয় দারুন। জন্মাষ্টমীতে বাংলার ঘরে ঘরে তাল এর বড়া বানানো হয়।
রেসিপি: তাল কেটে শাঁস ছেঁকে নিতে হয়। নারকেল কোরানো, আটা, গুড় মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি হয়। ছোট ছোট গোলা গরম তেলে ভেজে তোলা হয়। একদিন রেখে খেলে এর স্বাদ আরও ভালো হয়।
৫. পেঁয়াজি আর আলুর চপ:– বৃষ্টির সন্ধ্যা মানেই পেঁয়াজি আর আলুর চপ। চা আর পকোড়ার সম্পর্ক সারা ভারতে একরকম। বাংলায় বৃষ্টির দিনে দোকানে দোকানে ভাজা হয় পেঁয়াজি আর আলুর চপ। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে এগুলো খাওয়ার আনন্দ আলাদা।
৬. মরশুমি সবজির সঙ্গে মাছের ঝোল: বর্ষায় প্রতিদিনের খাবার মাছের ঝোল। রুই বা কাতলা মাছ দিয়ে আলু, কুমড়ো, পটল, টমেটো মিশিয়ে হালকা ঝোল বানানো হয়। আদা, জিরে গুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝোল হয় স্বাদে হালকা কিন্তু ভীষণ আরামদায়ক। সর্ষের তেলে রান্না করলে গন্ধ হবে দারুণ। খাওয়ার সময় লেবুর রস মেখে নিলে স্বাদ আরও বাড়ে।
এই পদগুলো শুধু খিদে মেটায় না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা বাংলার ঐতিহ্যকেও বাঁচিয়ে রাখে। তাই বৃষ্টির দিনে সুযোগ পেলেই এসব পদ ঘরে বানিয়ে ফেলুন, অথবা রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করুন। তাহলেই মিলবে বাংলার বর্ষার আসল স্বাদ।