যিনি রাধা, তিনিই কৃষ্ণণ!
দিব্যেন্দু ঘোষ
শুধু মোদি-শাহের পদলেহনই কি দেশের সর্বোচ্চ কিছু পদে টিকে থাকার মূল মন্ত্র? অনেকটাই। তবে সবটা নয়। ধনখড় কেন সরলেন? অসুস্থতা কারণ নয় মোটেই। বাংলায় রাজ্যপাল থাকার সময় বারবার, একাধিক ইস্যুতে নিরন্তর খাস্তা করেছেন মমতা সরকারকে। সংবিধান ভাল জানেন, দুঁদে উকিল। না হলে মমতার সঙ্গে টক্কর দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এমন মানুষ ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঝানু রাজনীতিককে অস্বস্তিতে ফেলা সহজ নয়। ভালই জানেন মোদি-শাহ। তাই জগদীপ ধনখড়। তিনিও মোদি-শাহের কৌশলের রূপকার। ফলে উপরাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। পুরস্কার। মমতাকে যতই বেগ দিন, উপরাষ্ট্রপতি হতে সেই মমতার দলেরই সমর্থন পেয়ে যান। মোদির ক্যারিশমা এখানেই। নিন্দুকেরা বলে, একসময় কংগ্রেসের কোলের ছেলে হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে দিয়েই মমতাকে রাজি করিয়ে ফেলেন মোদি। ভোটদানে বিরত তৃণমূল, চোখ বন্ধ করে উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়। কিন্তু এবারও তেমনটা হবে কি? রাজধানীর অলিন্দে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুদর্শন রেড্ডি মমতার পছন্দের প্রার্থী। ফলে এবার এনডিএ প্রার্থী রাধাকৃষ্ণণকে তৃণমূলের পরোক্ষ সমর্থনেরও প্রশ্ন নেই। জানেন মোদি। ইন্ডিয়া জোটের শরিক না থাকলেও আপ-কেও কার্যত সুদর্শনে রাজি করিয়ে ফেলেছেন মমতা। চাপ বাড়ছে এনডিএ শিবিরে। রাধাকৃষ্ণণ এর আগে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল ও তেলেঙ্গানার অতিরিক্ত রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব সামলেছেন। পুদুচেরির লেফটেন্যান্ট গর্ভনরও ছিলেন। কোয়েম্বাটুর থেকে পদ্মফুল প্রতীকে দুবার সাংসদ। তামিলনাড়ু বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি। দক্ষিণ ভারত বরাবরই বিজেপির দুর্বল ঘুঁটি। তাই একজন তামিলকে উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে দক্ষিণে নিজের জায়গা পোক্ত করার চেষ্টা বিজেপির। ভোটের আগে তামিলনাড়ু ও দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে আসর জমানোর মরিয়া চেষ্টা। ২০২২-এ কৃষক আন্দোলনের সময় জাট সমাজকে বার্তা দিতে ধনখড়কে বেছে নিয়েছিল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে তাঁর বিতর্কিত ভূমিকা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সঙ্গে সংঘাতের অভিজ্ঞতাকেই পুঁজি করেছিলেন মোদি-শাহ। কিন্তু রাধাকৃষ্ণণ কৈশোর থেকে আরএসএস ও জনসংঘের সঙ্গে যুক্ত। মৃদুভাষী, শান্ত স্বভাবের মানুষটিকে উপরাষ্ট্রপতির পদে বসিয়ে একদিকে আরএসএস, অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতকে খুশি করতে চাইছেন মোদি।
তিনি তামিলনাড়ুর ভূমিপুত্র। দক্ষিণের রাজনীতি হাতের মুঠোয়। ওবিসি সমাজের প্রতিনিধি। ওবিসি নিয়ে সরব রাহুল গান্ধী। তাদের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজন। যতটা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। সেই আবহেই ‘মাস্টারস্ট্রোক’ মোদির। অভিজাত নির্বাচনে এগিয়ে থাকছেন তাই মোদিই। গত বছরই বিজেপিশাসিত মহারাষ্ট্রের রাজভবনে চন্দ্রপূরম পন্নুসামি রাধাকৃষ্ণণকে বসিয়েছেন মোদি-শাহ। মাসকয়েকের মধ্যেই ‘প্রোমোশন’। মাত্র সতেরো বছর বয়স থেকেই জুড়ে গিয়েছিলেন সংঘ পরিবারের সঙ্গে। একেবারে তৃণমূল স্তরে নেমে কাজ করেছেন তামিলনাড়ুর গোন্ডা সমাজের রাধাকৃষ্ণণ। ২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ছিলেন তামিলনাড়ু বিজেপির রাজ্য সভাপতি। ওই সময় ৯৩ দিনব্যাপী ১৯ হাজার কিলোমিটার একটি রথযাত্রাও করেছিলেন তিনি। দক্ষিণের রাজনীতিতে যা ছিল বেনজির। ২০২০-তে কেরল বিজেপির দায়িত্ব। নিজের রাজনৈতিক জীবনে বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ও সৌজন্য চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে। সেখানকার শাসক শিবির ডিএমকে-র সঙ্গে ভালই সমীকরণ। রাধাকৃষ্ণণ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। তামিলনাড়ুতে তাদের ভোট শতাংশ সর্বাধিক। প্রায় ৬৪ শতাংশ। তাই বিজেপির কাছে এটা এখন ডিভিডেন্ডের জায়গা। কারণ, বছর ঘুরলেই ভোট।
উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন লোকসভা এবং রাজ্যসভার সাংসদরা। বর্তমানে লোকসভায় ৫৪৩টির মধ্যে কেবল বসিরহাট আসনটি খালি। তৃণমূলের হাজি নুরুল মারা গেছেন। রাজ্যসভায় ২৪৫টি আসনের মধ্যে খালি রয়েছে পাঁচটি আসন। দু’কক্ষ মিলিয়ে ভোটার ৭৮২। অর্থাৎ নির্বাচনে জিততে প্রয়োজন ৩৯২টি ভোট। দুই কক্ষ মিলিয়ে শাসক শিবিরের শক্তি ৪২৫-এর বেশি। বিরোধী জোট ৩২৬-এর মতো। সুতরাং ভোটাভুটি হলে রাধাকৃষ্ণণের জয় কার্যত নিশ্চিত। তবে কিছু সমস্যা আছে। এই নির্বাচন হয় গোপন ব্যালটে। সুতরাং ক্রস ভোটিং বা এদিকের ভোট ওদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। তবে এই বাধা পেরনোর পথ তৈরি করে রেখেছে বিজেপি। বিতর্কহীন, শাসক-বিরোধী রসায়ন বোঝেন, এমন উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে বিরোধীদের বাধার মুখে পড়তে হবে না। আশা বিজেপির। যেমন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় পড়তে হয়নি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। শাসক-বিরোধী ভারসাম্যই এখানে ভোট-মাইলেজ দেয়। তামিলনাড়ুতে পরের বছর ভোট। সেখানে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ককে যাতে বিরোধী এআইডিএমকে হাতিয়ার না করে, সেটা মাথায় রাখতে হবে শাসক গোষ্ঠী ডিএমকে-কে। তাই রাধাকৃষ্ণণের পথ ততটা রুক্ষ নয়। বিরোধীরাও সুদর্শন রেড্ডিকে প্রার্থী করে দক্ষিণী বার্তা দিয়েছে। তবে দক্ষিণী-অস্মিতার প্রশ্নে অনেক এগিয়ে রাধাকৃষ্ণণ। তাই আড়ালে আবডালে অনেক বিরোধীই বলছেন, যিনি রাধা, তিনিই কৃষ্ণণ!
