সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার দিন শেষ হতে চলেছে। অত্যাধুনিক রোবোটিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় রোগীরা এখন আরও দ্রুত, উন্নত ও নির্ভুল চিকিৎসার সুবিধা পাবেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই নতুন সংযোজন শল্যচিকিৎসার পদ্ধতিকে আধুনিকতার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যা অস্ত্রোপচারের নির্ভুলতা ও কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের এসএসকেএম হাসপাতালে রোবোটিক অস্ত্রোপচারের জন্য উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছে কেমব্রিজের একটি সংস্থা, যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা। সরকারি সূত্রের খবর, গত দুই বছর ধরে সরকারি হাসপাতালে রোবোটিক সার্জারির পরিকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছিল। দরপত্র আহ্বান ও অন্যান্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর অবশেষে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে রোগীরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রোবোটিক অস্ত্রোপচারের সুবিধা পাবেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, বেসরকারি পর্যায়ে এই প্রযুক্তির বিস্তার বাড়াতে হলে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রোবটের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।
চিকিৎসকদের দাবি, বিদেশি রোবটের অত্যধিক ব্যয় চিকিৎসার খরচ বাড়িয়ে দেয়, ফলে অনেক রোগীর পক্ষে এই পরিষেবা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। যদিও উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রোপচার রোগীদের দ্রুত আরোগ্য লাভের সুযোগ করে দেয়, তবে ব্যয়ের সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এটি সহজলভ্য নয়। তাই ভারতের মতো দেশে কম খরচে রোবোটিক অস্ত্রোপচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে উন্নত চিকিৎসা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেও আসে।
বর্তমানে ইউরোলজি, হৃদরোগ, শল্য চিকিৎসা, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, স্ত্রীরোগ, কিডনি, ফুসফুস, মাথা-গলা, স্তন ও কোলন ক্যানসারের মতো জটিল অস্ত্রোপচারে রোবোটিক সার্জারির গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি রোবট, বিশেষ করে ‘দ্য ভিঞ্চি’ রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রতিটি রোবট নির্দিষ্ট সংখ্যক অস্ত্রোপচারের পর পরিবর্তন করতে হয়, যার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সেই সঙ্গে বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের খরচও বেশি, ফলে সাধারণ রোগীদের জন্য এই প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সংকটের সমাধানে স্বদেশীয় প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে স্থানীয়ভাবে নির্মিত রোবটিক সরঞ্জাম ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে গুরুগ্রামের একটি সংস্থা, ‘এসএস ইনোভেশন’, পরীক্ষামূলকভাবে একটি নতুন ধরনের রোবটিক সিস্টেম তৈরি করে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পর, ২০২২ সাল থেকে এটি হাসপাতালগুলিতে অস্ত্রোপচারের জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত ‘এসএসআই মন্ত্র’ রোবটের নতুন সংস্করণ আগের তুলনায় আরও উন্নত হয়েছে এবং বিদেশি যন্ত্রের তুলনায় অনেক কম খরচে অস্ত্রোপচার করার সুবিধা দিচ্ছে। বর্তমানে এটি দেশের ৭৫টি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সার্জারির খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করছে বলে সংস্থার দাবি।
গুরুগ্রামে আয়োজিত এক সম্মেলনে রোবোটিক অস্ত্রোপচারের প্রসার ঘটাতে বিশেষভাবে তৈরি একটি চলমান চিকিৎসা বাস উদ্বোধন করা হয়েছে। এই বাসটিতে রোবোটিক অস্ত্রোপচারের আধুনিক সরঞ্জাম সংযুক্ত রয়েছে, যা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে চিকিৎসা পরিষেবা দেবে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সুধীর শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, এই রোবটের পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় বাহু একসঙ্গে কাজ করতে সক্ষম, যার ফলে জটিল হৃদরোগের অস্ত্রোপচার আরও সহজ ও কার্যকর হবে।
রাজ্যের বেশ কিছু সরকারি হাসপাতাল দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত এই রোবট ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, ‘সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন’ (সিডিএসসিও) ইতিমধ্যেই টেলিসার্জারির জন্য দেশীয় রোবট ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। আগামী দিনে আরও বেশি সংখ্যক হাসপাতাল এই প্রযুক্তির আওতায় আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি আয়োজিত সম্মেলনে রোবোটিক অস্ত্রোপচারের অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এই প্রযুক্তির অন্যতম পথিকৃৎ ফ্রেডেরিক মোল, খ্যাতনামা পদার্থবিদ মিচিও কাকু, পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকসহ আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রোবোটিক সার্জারির প্রসার কীভাবে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা যায়, তা নিয়েই মূলত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখন দেখার, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি কত দ্রুত সাধারণ মানুষের জন্য আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
Leave a comment
Leave a comment