রাজনীতি আর ধর্ম যেনো টাকার এপিঠ আর ওপিঠ। রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটবে না সেটা কি করে হয়। রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ হবে না সেটাও চিন্তা করা একদম ভুল। এই নিয়ে রাজনীতির দলগুলো এই দল ওই দলের গায়ে কাদা ছোঁড়ছুঁড়ি অব্যাহত।
আর ঠিক তার মাঝেই ধর্ম নিয়ে রাজ্যজোড়া আকচাআকচির ফাঁক গলে শ্রী রামকৃষ্ণ আগমার্কা বিপ্লবীদের সম্মেলনের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছেন জ্বলজ্বল করে। শুধু তাঁর ছবিওয়ালা পোস্টারই নয়, সঙ্গে রয়েছে তাঁর পরিচিতিও। “রামকৃষ্ণ পরমহংস। ব্রিটিশ ভারতের হুগলির কামারপুকুরে এক দরিদ্র বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী মন্দিরে পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় ভক্তিবাদের প্রভাবে তিনি আরাধনা শুরু করেন।” সত্যিই এও দেখতে হল আমাদের এই কমিউনিস্টদের সম্মেলনে।
মনে পড়ে বহুদিন আগে তারাপীঠে পুজো দিয়ে সুভাষ চক্রবর্তী হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, জয় মা তারা। দলের কোনও ভ্রুকুটিকে পাত্তা না দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি আগে হিন্দু, পরে কমিউনিস্ট। সেকালে এমন কথাবার্তা শুনলে দু’কানে হাতচাপা দিতেন নিষ্ঠাবান কমরেডরা। কিছুই হয়নি দাপুটে সুভাষবাবুর। হজ সেরে ফিরে রেজ্জাক মোল্লাও দিব্যি ছিলেন পার্টিতেই। সেই ধরি মাছ না ছুঁই পানি নিয়ে একরকম ছিল সিপিএম।
তা বলে রাজ্য সম্মেলনের প্রদর্শনীতে রামকৃষ্ণ, তারকেশ্বর মন্দির, ফুরফুরা শরিফ! এসবই রয়েছে হুগলি জেলার পরিচিতি হিসেবে সম্মেলন জুড়ে। এমনিতে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন নিয়ে বিশেষ কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সেই আলিমুদ্দিন নেই, সেই রাইটার্সে একটানা একচেটিয়া শাসনও নেই। পাড়ায় পাড়ায় সেই লোকাল কমিটির দাপট নেই। নেই সেই কাতারে কাতারে কমরেড, ব্যালট বাক্স উপচে পড়া ভোট। সেসবই এখন অতীত। তাদের দাপটের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছে সে সবই। থাকার মধ্যে আছে সেই মেজাজ, নিজেদের মধ্যে গ্রুপবাজি, নানারকম তাত্ত্বিক তক্কো, কেরল বনাম বাংলা লবির সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ। কমবয়সের নানা মুখ এনে বাজারে নামালেও হালে পানি পাচ্ছে না ৬১ বছরের পুরনো এই দলটা।
বিধানসভায় নেই, লোকসভায় নেই, এমনকী রাস্তাতেও নেই। ফলে লোকের তেমন কোনও আগ্রহও নেই আর এই একদা দাপুটে লাল পার্টির নেতাদের। তবু এরই মধ্যে সিপিএমের সম্মেলনে রামকৃষ্ণর ছবি খানিকটা নজর টানে বই কি। যে রামকৃষ্ণ ছিলেন ‘ভাববাদী, যে রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলগুলোর বারোটা বাজাতে উঠে পড়ে লেগেছিল জ্যোতিবাবুর দল, সেই রামকৃষ্ণ। তবে কি এতদিনে ধর্মের লাইনে হাঁটতে চলেছে আগমার্কা বিপ্লবীরা? একসময় জ্যোতি বসু সভায় সভায় বলে বেড়াতেন, বরানগরে যখন তিনি ভোটে লড়তে গিয়েছিলেন তখন কংগ্রেস থেকে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলে লক্ষ্মীপুজো বন্ধ করে দেবে। তারা ধর্ম মানে না এমনটাই ছিল প্রচার। পরে দেখা গেল, দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের বাইরে ম্যারাপ খাটিয়ে মার্কসবাদী বইপত্র বিক্রি করছেন কমরেডরা। তা নিয়েও কথা কিন্তু কম হত না।
এটুকু বাদ দিয়ে সিপিএম আছে সিপিএমেই। সেই এক কোন্দল দলের ভিতর। উত্তর, দক্ষিণ দুই চব্বিশ পরগনার সম্মেলনেই তুমুল গোলমালের খবর বাইরে এসেছে। দুই দলের দুই প্যানেল। এক জায়গায় তো খোদ সম্পাদক হেরে গিয়েছেন। আরেক জেলায় দুই নেতার দুই প্যানেলে জোর লড়াই। কে বলবে গত এক যুগ পার্টি ক্ষমতায় নেই। তারই মধ্যে কোন ফর্মুলায় তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবে তা নিয়ে গবেষণায় ক্ষান্তি কোনোও নেই। নতুন মুখ এনেও খুব একটা কিছু লাভ হয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে এক চুলও এগোনো যায়নি। এই সম্মেলনেও এসব নিয়ে চুলচেরা মার্কসবাদী তত্ত্বের লড়াই কম হল না।
কোন পথে যে ভোট বাড়বে, অন্তত মুখরক্ষার মতো একটা দুটো সিট মিলবে তা ঠিক করতে দৃশ্যতই দিশেহারা তারা। তৃণমূলকে উঠতে বসতে গালমন্দ করে যে আখেরে লাভ হচ্ছে না তা বুঝতে পেরে এখন অভিনব পথ ধরেছে তারা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, যুবশ্রীর মতো বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প নিয়ে প্রচার করার লাইন নিয়েছে তারা। ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম কর্মশালাও করে ফেলেছে। প্রকল্পগুলির নাম ধরে ধরে তৈরি করা হয়েছে একটি পুস্তিকাও। কোন প্রকল্প কারা কীভাবে সুযোগ পাবেন তা বিস্তারিত লেখা আছে তাতে। কে বলবে কয়েকদিন আগেও এসব প্রকল্পকে খয়রাতি বলে কটাক্ষ করতেন সিপিএমের বিদগ্ধ নেতারা! সত্যিই বিচিত্র এই রাজনীতি আর সেই রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ। এতদিন যা সিপিএমের পার্টিতে ছিল না সেটাই দেখতে হলো আমাদের। জয় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জয়। জয় লাল পার্টির জয়।