১৯১১ সালে অমর একাদশের ফুটবলার ও মোহনবাগান রত্ন মনমোহন মুখার্জী। ওনার পুত্র বিমল মুখার্জী ১৯৩৯ সালে মোহনবাগানের প্রথম কলকাতা লীগ জয়ের অধিনায়ক। মোহনবাগান লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট প্রাপ্ত বিমল মুখার্জী হুগলীর উত্তরপাড়ার গর্ব। উত্তরপাড়া বালি কোন্নগর মেরিনার্স ফোরামের পক্ষ থেকে এই মুখার্জী পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উত্তরপাড়া কোতরঙ পুরসভার চেয়ারম্যান দিলীপ যাদব বলেন, আমরা গর্বিত আমাদের শহরে এমন দুই কৃতী ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেছেন বলে। যাঁদের জন্য শুধূ উত্তরপাড়া নয় গোটা দেশ গর্বিত। তাঁদের এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য। আমরা মনমোহন মুখোপাধ্যায় এর নামে তাঁর বাড়ির সামনে রাস্তার নামকরণ করলাম মনমোহন মুখোপাধ্যায় রোড। এই অনুষ্ঠানে এই বিমল মুখোপাধ্যায় এর পরিবার ছাড়াও হাজির ছিলেন বিশিষ্ট প্রাক্তন ফুটবলার ও সাংসদ প্রসূন ব্যানার্জী, মোহনবাগান সচিব দেবাশীষ দত্ত ও উত্তরপাড়া কোতরঙ পুরসভার চেয়ারম্যান দিলীপ যাদব। এই দুই কৃতী সন্তানের মূর্তি স্থাপন করেছে পুরসভা আগেই। পুরোনো দিনের মানুষকে মনে রেখে এই অনুষ্ঠানকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন প্রাক্তন বিশিষ্ট ফুটবলার ও বর্তমান সাংসদ প্রসূন ব্যানার্জী। মোহনবাগান সচিব দেবাশীষ দত্তের কথায় এই দুই মোহনবাগানের রত্নকে স্মরণ করে তাঁদের পরিবারকে নিয়ে এমন আনন্দের একটি অনুষ্ঠানে হাজির হতে পেরে আমি গর্বিত।
আসলে শহরের বুকে হারিয়ে যাওয়া এই বাড়ির নানা স্মৃতি। এই বাড়ির মানুষদের কর্মকৃতিত্ব তো ভুলে যাবার নয় কিছুতেই, কোনো ভাবেই। স্বাধীনতার আগের যুগের সেই সময় এমনই নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়ী। যেখানে শুধু খেলার মাধ্যমে জেগে উঠেছিল দেশপ্রেমের দীপশিখা। খেলার মাঠে বিদেশিদের হারিয়ে দিয়ে সেদিন বাংলার কিছু তরতাজা যুবক বুঝিয়ে দিয়েছিল তারাও কম যায় না। সেই দলে ছিলেন হীরালাল মুখোপাধ্যায়, ভুটি সুকুল, সুধীর চট্টোপাধ্যায়, মনমোহন মুখোপাধ্যায়, রাজেন সেনগুপ্ত, নীল মাধব ভট্টাচার্য, কানু রায়, হাবুল সরকার, অভিলাষ ঘোষ,বিজয় দাশ ভাদুড়ী, আর অধিনায়ক ছিলেন শিবদাস ভাদুড়ী। সেই দিনটি সত্যিই ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকাল।
ঊনত্রিশ জুলাই এই তারিখটা ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম একটা আবেগের দিন। উনিশশো এগারো সালের এই দিনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এগারো জন দামাল বাঙালি ছেলে ইস্ট ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে মুখোমুখি হয় মোহনবাগান দল। আর সেই ম্যাচে ঐতিহাসিক জয় পায় সেই সবুজ মেরুন মোহনবাগান। সেদিন বুট পরে খেলতে নামা ইংরেজদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলতে নামে খেলা পাগল বাঙালির কিছু তরতাজা যুবক ফুটবলার।
তাদের অদম্য জেদের কাছে হার মেনে নেয় ব্রিটিশরা। আর সেই দলে ছিলেন উত্তরপাড়ার সেই মনমোহন মুখোপাধ্যায়। উত্তরপাড়ার শিবতলা স্ট্রীটের এই বাড়ী ছিল মনমোহনের ছোটবেলার আস্তানা। যে বাড়ী আজও দাঁড়িয়ে আছে নানা স্মৃতিকে আগলে নিয়ে। সেই মোহনবাগানের অমর এগারোর একজন যোদ্ধা ছিলেন এই মনমোহন মুখোপাধ্যায়। আড়াইশো বছরের পুরনো বাড়ী আজও বহন করে চলেছে সেই ইতিহাস। বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়ছে কিন্তু আজও এই বাড়ী ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনমোহন স্মৃতিকে বুকে আগলে ধরে।
কিন্তু যে মানুষটার বাবা একজন এত বিখ্যাত ফুটবলার। সেই বাবার ছেলে বিমল মুখোপাধ্যায় এর খুব ইচ্ছা তিনিও মোহনবাগান মাঠে খেলবেন একদিন। এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। খুব সাধ তাঁর ওই বাবার দলে খেলার। কিন্তু উপায় কি খেলব বললে কি আর খেলা যায় মোহনবাগানে। কিছুতেই সেই মাঠের এদিক ওদিক ঘুরেও কোনো ফল হলো না তাঁর।
কিছুতেই যখন মোহনবাগান মাঠে খেলার ছাড়পত্র মিলছে না সেই সময় তিনি মনস্থির করেন ঠিক আছে তাহলে পাশের ইস্টবেঙ্গল মাঠেই খেলতে নামবেন তিনি। একজন পরিচিত বলেন ঠিক আছে চেষ্টা করে তিনি দেখবেন কি করা যায়। সেই পরিচিত মানুষের হাত ধরে ইস্টবেঙ্গল মাঠে খেলা পাকা করে ফেলেন বিমল মুখোপাধ্যায়। কিন্তু কোনো ভাবে এই খবর গেলো মোহনবাগান টেন্টে। মনমোহন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে সই করছে ইস্টবেঙ্গলে।
ব্যাস আর কি। সোজা বিমল বাবুকে ডেকে পাঠানো হয় মোহনবাগান টেন্টে। বিমল মুখোপাধ্যায় এলে তাঁকে বলা হয় যদি প্রমাণ করতে পারে সে খেলতে পারবে ঠিক মত। তাহলে সুযোগ মিলবে মোহনবাগানে খেলার। আর প্রথম খেলাতেই বাজিমাৎ করলেন বিমল মুখোপাধ্যায়। পুলিশের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে তিনি প্রমাণ দেন। প্রথম ম্যাচেই দু গোল করেন তিনি।
তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে কোনোদিন। উনিশ শো ত্রিশ সাল থেকে টানা দশ বছর চুটিয়ে খেলেন তিনি সবুজ মেরুন জার্সি পরে রাইট হাফে। উনিশশো আটত্রিশ সালে বিমল কে ক্যাপ্টেন করা হয় মোহনবাগানের। আর উনিশ শো উনচল্লিশ সালে মোহনবাগানকে প্রথম লীগ খেতাব এনে দেন সেই তিনি। সত্যিই যে মানুষটা এই মোহনবাগানে খেলতে সুযোগ পাচ্ছিলেন না সেই মানুষটা কেমন ইতিহাসের পাতায় পৌঁছে গেলেন অনায়াসে। সেই বাবা আর ছেলেকে সম্মান জানাতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন।
