সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
পুনঃ মুষিক ভব। ভোট রাজনীতির ময়দানে ফের অনেক আগে থেকেই এগিয়ে শুরু করল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। সরকারি পরিষেবায় দুর্নীতির পাঁকে জড়িয়েও প্রায় 15 বছর সরকারি ক্ষমতায় থাকার অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর এড়িয়ে যখন জনরোষে ভেসে যাওয়ার কথা শাসকদলের তখন ভুতুড়ে ভোটারকে সামনে রেখে ছাব্বিশের এর ভোটের ময়দানে বাড়ি বাড়ি দরবার করতে ইতিমধ্যেই শুরু করেছে রাজ্যের শাসক দল। রাজ্য রাজনীতিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মতবাদের জনক রাজ্যের ৩৪ বছরের শাসক বামপন্থীরা যেমন দিশাহীন তেমনি গত ১০ বছর কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকা মোদি-শাহের রেজিমেন্টেড ক্যাডারবেস পার্টি বিজেপির অবস্থাও তথৈবচ। বিরোধী রাজনীতির বক্তব্য, তাদের দল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। তাদের নিজস্ব সিস্টেম আছে। সেই সিস্টেম অনুযায়ী সমস্ত কর্মসূচি যথাসময়ে করা হবে। তৃণমূলের রাজনীতিকে ডোল পলিটিকস বা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বলেও কটাক্ষ করেছেন। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিস্টেমের দোহাই দিয়ে লাভ নেই, পাল্টা রাজনৈতিক কৌশল ও সরকারি মেকানিজমকে সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ভিটে-মাটি হারানো বিরোধীপক্ষকে জনবিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়াতেই ভোটের ময়দানে ফের এগিয়ে তৃণমূল।
একটা সময় ছিল যখন ভোটের দুদিন আগে থেকেই দিনরাত এক করে রাজনৈতিক কর্মীদের পাহারা দেওয়ার চল ছিল। কারণ তখন গ্রামের মোড়লদের মাধ্যমে চাল-কম্বল বিলি করার রেওয়াজ ছিল। সেগুলোকে ধরতেই এই রাত পাহারার ব্যবস্থা। এখন তার প্রয়োজন হয় না। এখন সরকারি স্কিমের মাধ্যমে সরাসরি সারাবছর ধরে বিলি হয়। ফলে সরকারি স্কিম যদি ঠিকভাবে বছরভর পরিচালনা করা যায় তাহলে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বেড়ে যায়। গত 14 বছরে বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প চালু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যেভাবে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন সেখান থেকে মুখ ফেরাতে পারছেন না সাধারণ মানুষও বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে ভোটমুখী মানুষকে কিনে নেওয়ার যে সরকারি মেকানিজম তা এই পরিবর্তনের সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে এমনটা নয়। ” চাল গম টাকা/ ভোটের জন্য রাখা/ দিচ্ছি বড় বুলি/ দেশকে ডকে তুলি।” ষাটের দশকে দেওয়ালে দেওয়ালে ভোটের আগে এধরনের স্লোগান অহরহ চোখে পড়তো। এমনকি বাম জামানায় আশির দশকেও লোকসভা নির্বাচনের আগে এ ধরনের স্লোগান চোখে পড়েছে। কংগ্রেসকে বিঁধে এই দেওয়াল লিখন তৈরি করেছিলেন বামপন্থীরাই। আবার পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছিল বাম আমলেই। কৃষক ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একাধিক ভাতা চালু ছিল সরকারি মেকানিজমেই। কিন্তু দলীয় বৃত্তের বাইরে গিয়ে সেই পাওনাগণ্ডা সর্বজনীন করতে পারেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। বরং দল-মত না দেখে বর্তমান সময়ে সমাজের বৃহত্তম অংশে যে পাইয়ে দেওয়ার সরকারি রাজনীতির প্রক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড চলছে সেখানেই হালে পানি পাচ্ছেন না বিরোধীরা বলে মনে করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে “ভোটের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ভোট”?
তবে আগে সরকারি পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে আমরা-ওরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেই পরিস্থিতির অনেকটাই বদল করতে পেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি তুলনামূলকভাবে অনেকটা বেশি দলমত নির্বিশেষে মানুষের দরজায় পৌঁছে দিতে পেরেছে মমতার সরকার। আর সেখানেই তিনি বাজিমাত করেছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ধোপদরস্থ ও কেতাবি মানুষজনের বিরোধিতা জনমানসে তাই প্রভাব ফেলতে পারছে না। যে কারণে ভোটবাজারেও বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল অনেকটা এগিয়ে থেকেই শুরু করছেন।
প্রশ্ন উঠেছে রেজিমেন্টেড বা ক্যাডার ভিত্তিক দল হয়েও বিজেপি- সিপিআইএম এক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে কেন? প্রতিষ্ঠান বিরোধী গণ আন্দোলন তৈরিতেও কোন উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারছে না কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে আসলে নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে অপরিণামদর্শী রাজনীতি করতে গিয়ে এবং নিজেদের অতীত কাজকর্মই এক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরোধী শক্তির কাছে। মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের যথাযথ ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়েও তারা জনমানসে সেভাবে হুল ফোটাতে পারছেন না। ইন্দিরা গান্ধীকে যখন মহাজোট করে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তখন বামপন্থীরা ইন্দিরার পাশে ছিলেন। আবার কংগ্রেস সরকারকে ফেলতে বিজেপি-বাম হাতে হাত মেলায় দিল্লিতেই। ইউপিএ সরকারের আমলে কংগ্রেসকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন বামেরা। আবার বিজেপি যখন রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধাচারণ করছে তখন সহায়হীন হয়ে কার্যক্ষেত্রে বিজেপিকেই সঙ্গ দিচ্ছে বামেরা। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বহুত্ববাদী সমাজের ধারণা বারবার ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সর্বোপরি মানুষের আন্দোলনের পরিবর্তে বিরোধীদের নিজেদের ক্ষমতা দখলের মানসিকতার বিষয়টি প্রকট হওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির চাহিদা ও প্রাপ্তি মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। তাই তৃণমূলকে “চোর” হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হলেও যারা চিহ্নিত করতে চাইছেন তাদের ভূমিকা, নীতি-আদর্শ বা অতীত যে তৃণমূলের থেকে কোন অংশে কম নয় সেটাও মানুষের কাছে বিচার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল বিরোধী জনমত তৈরিতে যারা কুশীলবের ভূমিকা পালন করবেন তারাই মানসিকভাবে দুর্বল এবং সমদোষে দুষ্ট বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ আর এখানেই তৃণমূলের অ্যাডভান্টেজ। যা বারবার বাংলার রাজনীতিতে প্রকট হচ্ছে।