অক্সফোর্ডের মাটিতে ‘অন্য মেয়ের উপাখ্যান’, মমতা যেন ভারতীয় রাজনীতির ‘হুইসেল ব্লোয়ার’
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
“আমি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো বাঁচি। আপনাদের সাধ্য থাকলে আমাকে ধরুন। মনে রাখবেন ট্রেনের হুইসেল যদি শুনতে বা বুঝতে না পারেন তাহলে আপনি কয়েকশো মাইল পিছিয়ে পড়বেন। শূন্য থেকে আরও শূন্যতম হয়ে যাবেন।” আমেরিকান গীতিকার হেডি ওয়েস্ট এর লেখা সেই বিখ্যাত গান ‘ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস’ গানটার কথা নিশ্চয়ই সকলেরই জানা। সেই গানের পংক্তি স্বরণ করিয়ে দিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে এই রাজনৈতিক বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝিয়ে দিলেন ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি এখন “হুইসেল ব্লোয়ার”। হুইসেল( পড়ুন মানুষের পালস) বুঝতে না পারলে তিনি একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন। ঝরঝরে ইংরেজিতে চোয়াল শক্ত হলেও নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে চোখা চোখা প্রশ্নের সামনে নিজেকে সামলে রেখে এবং প্রতিটা প্রশ্নের যথোপযুক্ত উত্তর দিয়ে বাংলার অগ্নিকন্যা বুঝিয়ে দিলেন তিনি এখন ‘অন্য মমতা’। তাকে না বুঝতে পারলে তিনি যে মাইলফলকের শীর্ষে বহুদূর এগিয়ে যাবেন সে কথা জানিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ঘরের মেয়ের নয়া উত্তরণের অনন্য উপাখ্যান। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়– ভারতীয় রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে এবং ভারতীয় রাজনীতির ভবিতব্যে “হুইসেল ব্লোয়ার”।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ভারতীয় সময় রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কিলক কলেজের অডিটোরিয়ামে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিচ্ছেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাকে অনেকেই “আটপৌরে মুখ্যমন্ত্রী” বলে উল্লেখ করেন। গোটা বিশ্বের অগ্রণী শিক্ষাঙ্গন অক্সফোর্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই আটপৌরে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা দেওয়া নিয়ে তথাকথিত এলিট শিক্ষিত সম্প্রদায় জল ঘোলা করার চেষ্টা ত্রুটি রাখবেন না তা কলকাতাতে বসেই টের পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করে তিনি লন্ডনের মাটিতে পা রেখেছেন সেটাও লন্ডনে পৌঁছে জানিয়েছিলেন মমতা নিজেই। নিজের ব্যক্তি জীবনে লড়াই সংগ্রামের পাশাপাশি তার রাজনৈতিক লড়াই নিয়ে তিনি যেমন তার বক্তব্যে ব্যাখ্যা করেছেন তার পাশাপাশি বিরোধী নেত্রী থেকে প্রশাসক হিসেবে উত্তরণের কাহিনীও বিবৃত করেছে। প্রশাসক হিসেবে তার সাফল্যগাথার বিবরণ দিয়েছেন, প্রয়োজনে বিরোধী বাম তথা গেরুয়া শিবিরকেও কটাক্ষ করতে ভোলেননি। মূলত মহিলা শক্তির জাগরণ বা কন্যাশ্রী থেকে মহিলাদের ক্ষমতায়ন কিভাবে পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজ্য সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে তাও জানান মমতা। কন্যাশ্রী থেকে লক্ষীর ভান্ডার, স্বাস্থ্য সাথী থেকে ছাত্র যুবদের জন্য স্কলারশিপ প্রকল্প, রাজ্যের শিল্পায়নের লক্ষ্যে শিল্প বান্ধব পরিস্থিতি তৈরি সবকিছুকেই ছুঁয়ে গিয়েছে মমতার বক্তব্য।ডিমনিটাইজেশন দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে কারো নাম উল্লেখ না করেই সে কথা বুঝিয়েছেন মমতা। এরপর করো না কালে দেশের অর্থনীতি তলা নিতে গিয়ে ঠেকেছে সেকথা উল্লেখ করে রাজ্যের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বিশেষ করে ঘরের মহিলারা যেভাবে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন সে কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি মমতা। বারবার আঘাত পেয়েও যেমন রাজনীতিতে যে তিনি আরো বেশি করে এগিয়ে এসেছেন ঠিক তেমনি রাজ্যের ভেঙে পড়া এই আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বুনিয়াদকে ফের শক্ত করতে ঘরের মহিলাদের ক্ষমতায়ন বা নারী শক্তিকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে কিভাবে নিয়ে গিয়েছেন সে কথা কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের সারমর্ম বুঝিয়ে ব্যক্ত করেন মমতা। উল্লেখযোগ্য, আর রাজনৈতিক লড়াই এবং সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর মূল শক্তি নারী শক্তি বা মহিলা ভোট দেন সে কথা কারো অজানা নয়। তাই নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন যে তার কাছে অন্যতম প্রাধান্য পায় তা বিলক্ষণ বোঝেন রাজনৈতিক মতামালম্বীরা। ৩৪ বছরের বাম জমানাকে সরাতে গিয়ে রাজ্যের আনাচে-কানাচে যেভাবে লড়াই সংগ্রাম প্রতিরোধের রাজনীতি একক হাতে তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই লড়াইয়ের কাহিনীই যে তার মূল অস্ত্র সে কথা জানেন মমতা নিজেও। তাই বক্তৃতার মাঝপথে কখনো আরজিকর বা অভয়া ইস্যু, কখনো সিঙ্গুর বা টাটা গোষ্ঠীর ইতিহাস, কখনো ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির অভিযোগ, কখনোবা তাঁর ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে যখন অডিটোরিয়ামের মধ্যে একের পর এক মমতাকে প্রশ্ন মানে জর্জরিত করা হয় তখন পাল্টা হিসেবে ১৯৯০ সালের ১৬ আগস্ট হাজরা মোড়ে তার মাথায় লাঠির আঘাত করে তাকে প্রাণ নাসের চেষ্টার ছবি তুলে ধরেন মমতা। বাঞ্জমানের লালু আলমের মমতার উপর সেই আক্রমণ এবং পরবর্তীতে একাধিক ক্ষেত্রে বাম নেতাকর্মীদের মমতাকে আক্রমণের ঘটনা, ৩৪ বছরের বাম জমানায় বাংলার অগ্নিকন্যায় পরিণত করেছিল মমতাকে। ৯০ সালের সেই ঘটনার ছবি ইন্লাজ করে অডিটরিয়ামের প্রেক্ষাগৃহে যখন পাল্টা অস্ত্র হিসেবে মমতা তুলে ধরেন। তখন হাততালিতে ফেটে পড়ে গোটা অডিটোরিয়াম। তার বিরুদ্ধে চোখাচোখা প্রশ্ন করা বামমনস্ক পড়ুয়াদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ গৌণ হয়ে পড়ে। তুমুল হইচই শুরু হলে যখন বক্তৃতা সাময়িক থামিয়ে মমতা অপেক্ষা করছেন ঠিক তখনই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য তথা কেলগ কলেজের প্রেসিডেন্ট জোনাথন মিশি তাকে সাময়িকভাবে বসার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামলে চলা মমতা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে বার্তা দেন ” এটাই ওদের চিরকালীন স্বভাব। গঠনমূলক কাজের বিরোধিতা করাই ওদের কাজ। ওরা সংখ্যায় ১০ থেকে ১২ জন। আপনারা যারা আমার কথা শুনতে এসেছেন তারা ওদের ইগনোর করুন।” ঠিক যেন সেই গানের কলি, ‘ যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কি আসে যায়?”।
বরং প্রশাসক মমতা জানিয়ে দেন “তার ধর্ম হল মানুষের ধর্ম। তার নিজস্ব কোন ধর্ম নেই। হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান জৈন শিখ সবই তার ধর্ম।” বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য যে ভারতের ঐতিহ্য সেই ভারতবাসী হিসেবে একতা ও মানবতায় তার ধর্ম বোঝালেন মমতা। একটি বারের জন্য মেজাজ না হারিয়ে, চোয়াল শক্ত করেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রতিটি কথার প্রত্যুত্তর দিয়ে পাশাপাশি ‘ইগনোর পলিটিক্স’ এর বার্তা দিয়ে নিজের বক্তব্যে অবিচল থাকেন মমতা। আর এখানেই বাজিমাত বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। তার রাজনৈতিক কৌশল বা হুইসেল অথবা রাজনৈতিকবোধ যদি সঠিকভাবে না বুঝে তাকে প্রতি আক্রমণ করা হয় তাহলে তার নাগাল কোনদিনই পাবে না বিরোধীপক্ষ। বরং শয়ে শয়ে মাইল পিছনে পড়ে থেকে শূন্যতর হয়ে যাবেন তারা। অক্সফোর্ডের মাটিতে। আর তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন যে ভারতীয় রাজনীতির ভবিতব্যে মমতাই “হুইসেল ব্লোয়ার”।
