মাঝেমধ্যেই নেপালে উঠছে রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবি।শুক্রবার পূর্ব কাঠমান্ডুর তিনকুনে এইরকমই এক দাবিতে মিছিল করেন হাজার-হাজার মানুষ।তাঁদের হাতে রাজা জ্ঞানেন্দ্রর ছবি, তাঁদের দাবি ‘দেশকে বাঁচাতে রাজা ফিরে আসুন’, ‘দুর্নীতিবাজ সরকারের পতন হোক’, ‘আমরা রাজতন্ত্র ফেরত চাই’। আর শুক্রবার এই মিছিলকে আটকানোর চেষ্টা হতেই তা হাতের বাইরে বেরিয়ে যায় পরিস্থিতি। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়।ঘটে পাথর ছোঁড়ার মত ঘটনা, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন বাড়ি ও গাড়িতে।পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমানবন্দর, গৌশালা, বানেশ্বর চক, তিনকুনে, কোটেশ্বর-সহ বিভিন্ন এলাকায় কার্ফু জারি করতে হয়।এমন ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২ জনের, সংঘর্ষে জখম হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন,ধৃত ১০০ বিক্ষোভকারী।
তবে এটাই প্রথম নয়,গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নেপালের গণতান্ত্রিক দিবসে প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহের ভিডিয়ো বার্তার পরে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে হিন্দু রাজতন্ত্রের দাবি। আবার ৯ মার্চ রবিবার এক আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী থাকে রাজধানী কাঠমান্ডু। “রাজা ফিরে আসুন, দেশ বাঁচান”, “আমরা রাজতন্ত্র চাই” এমন স্লোগানে মুখরিত হয় কাঠমান্ডুর আকাশ বাতাস। সেবার নেপালের পশ্চিমাঞ্চল সফর শেষ করে জ্ঞানেন্দ্র কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছন। তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন বিপুল সংখ্যক সাধারণ নাগরিক। যেখানে তখন একটাই দাবি ছিল — নেপালে হিন্দু রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনুন। রাজতন্ত্রপন্থীরা এবং সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলো লেখেন যে জ্ঞানেন্দ্রকে স্বাগত জানাতে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল।যদিও সংবাদসংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সে সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার।
২০০৮ সালে নেপাল একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার আগে পর্যন্ত নেপাল ছিল শেষ হিন্দু রাজতন্ত্র। নেপালে ২৪০ বছর ধরে চলেছে একটি হিন্দু রাজতন্ত্র। ১৯৯০ সালে, একের পর এক গণআন্দোলনের পর, বীরেন্দ্র নেপালকে একটি নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র থেকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রূপান্তর করতে সম্মত হন, একটি নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেন। ক্রাউন প্রিন্স দীপেন্দ্র মদ্যপ অবস্থায় ২০০১ সালের ১ জুন রাজা বীরেন্দ্র, রানী ঐশ্বর্যা এবং আরও আটজন রাজপরিবারের সদস্যকে হত্যা করেন। দীপেন্দ্র তিন দিন কোমায় থাকার পর মারা যান, এবং এরপর জ্ঞানেন্দ্র শাহ রাজা হন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে সাতটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে জনআন্দোলন শুরু হয়, যেখানে রাজার সরাসরি শাসনের অবসান দাবি করা হয়। জ্ঞানেন্দ্র চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন এবং ২০০৭ সালে সংসদ পুনর্বহাল করেন।২০০৮ সালে, মাওবাদী বিদ্রোহীদের আধিপত্যে নির্বাচিত সংবিধান সভা রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করার পক্ষে ভোট দেয়। ২৮ মে, ২০০৮ সালে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষিত হয়, এবং রাজা জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণহিতি প্রাসাদ ছেড়ে দেন। নেপাল, শেষ হিন্দু রাজতন্ত্র, একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। এবং নারায়ণহিতি প্রাসাদ এখন একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে।
নারায়ণহিতি প্রাসাদই এখন সেই জায়গা যেখানে মানুষ চায় জ্ঞানেন্দ্র রাজা হিসেবে ফিরে আসুন। কাঠমান্ডুর অলিতে গলিতে উঠছে সেই স্লোগান। ২০০৮ সালেই নেপালের ২৪০ বছরের পুরোনো হিন্দু রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে নেপালের মানুষ পেয়েছে ১৩টি সরকার। কেউ কেউ বলছেন দেশটির অনেকেই প্রজাতন্ত্রব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের দাবি, প্রজাতন্ত্রের সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। অনেকের মতে শুক্রবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড বা পুষ্পকমল দহাল পাল্টা রাজতন্ত্র বিরোধী সভা করে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেই অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ বার গণবিক্ষোভ রাস্তায় নেমে এসেছে তাঁকে ‘সিংহাসনে’ ফেরানোর দাবিতে। তবে কী গণতন্ত্র থেকে ফের রাজতন্ত্রের পথে হাঁটবে নেপাল? নতুন করে ইতিহাস লিখে নেপাল সে পথে যাবে কী না তা ভবিষ্যতই বলবে।
Leave a comment
Leave a comment
