সম্প্রতি বম্বে হাইকোর্টে এক পকসো (POCSO) মামলায় এমন এক রায় এসেছে, যা ঘিরে দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। আদালতের বিচারপতি মিলিন্দ এন. জাধব ২৪ বছর বয়সী এক যুবককে জামিন দিয়েছেন, যিনি এক ১৪ বছর বয়সী নাবালিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এই সম্পর্কের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে পকসো আইনে মামলা দায়ের হয় এবং তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে বন্দি ছিলেন।
আদালত তার রায়ে জানিয়েছে, ভুক্তভোগী কিশোরী যথেষ্ট পরিমাণ ‘জ্ঞাতসারে ও সচেতনভাবে’ অভিযুক্ত যুবকের সঙ্গে ছিলেন এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিতে সম্পর্ক হয়েছিল। বিচারপতির মতে, নাবালিকা তার কাজের পরিণাম বুঝে নিয়েছিলেন এবং তিনি জোরপূর্বক বা প্রতারণার শিকার ছিলেন না।
এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই বিচারপতি জামিন মঞ্জুর করেন এবং বলেন যে, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে অভিযুক্তকে বিচার ছাড়াই আটক রাখা ন্যায্য নয়। একইসঙ্গে আদালত আরও বলেন, ভুক্তভোগী একাধিকবার অভিযুক্তের সঙ্গে দেখা করেছেন, নিজের পরিবার থেকে পালিয়ে তার সঙ্গে থেকেছেন এবং দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল—যা ইচ্ছাকৃত বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
তবে এই পর্যবেক্ষণ ঘিরেই শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক। সমাজের একাংশ এবং শিশু অধিকার সংস্থাগুলোর মতে, পকসো আইনেই বলা আছে যে ১৮ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তির সম্মতিও বৈধ নয়। কারণ, আইনি দৃষ্টিতে কোনো নাবালক বা নাবালিকা পরিপূর্ণভাবে সম্মতির সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নন।
অনেকে বলছেন, এই রায় পকসো আইনের মূল উদ্দেশ্যকেই দুর্বল করে দিতে পারে। যেখানে শিশুদের যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১২ সালে আইনটি কার্যকর করা হয়, সেখানে এই ধরণের পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠলে অনেক অপরাধী আইনগত ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যদি আদালত মনে করে যে ভুক্তভোগী ‘পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন’ বা স্বেচ্ছায় ছিলেন।
এই মামলার বিস্তারিত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভুক্তভোগী নাবালিকা অভিযুক্তের সঙ্গে তিন দিন অবস্থান করেন এবং পরিবারের অনুমতি ছাড়াই অভিযুক্তের সঙ্গে ঘর ছাড়েন। পরে তার পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের হলে, অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং পকসো ধারায় মামলা দায়ের করা হয়।
যদিও আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ভুক্তভোগী তার বয়সের তুলনায় অনেকটাই সচেতন এবং সম্পর্কের বিষয়টি তার জানা ছিল। এমনকী অভিযোগকারী মেয়েটি তার জবানবন্দিতেও বলেছিলেন যে তিনি স্বেচ্ছায় অভিযুক্তের সঙ্গে ছিলেন।
অন্যদিকে, এই রায়ের পক্ষে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের মতে, প্রতিটি মামলার নিজস্ব বাস্তবতা ও প্রসঙ্গ থাকে। তাই সবক্ষেত্রে একই মানদণ্ড প্রয়োগ করা যায় না। অনেক সময়ই পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্ককেও পকসো আইনের আওতায় এনে যুবকদের শাস্তি দেওয়া হয়, যা পরে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিতে পারে।
এই অবস্থায় আইনজীবী মহল ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ স্পষ্টভাবে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। এটি হয়তো একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, তবে এমন রায় ভবিষ্যতে আইনের ব্যাখ্যার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই ঘটনা আবারও সামনে এনেছে পকসো আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক। বিশেষ করে ‘সম্মতির বয়স’ এবং আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে আরও স্পষ্টতা আনতে হবে কিনা, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়। কিছু অংশ মনে করছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগই শিশুদের রক্ষা করতে পারে, আবার কেউ বলছেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাস্তবতাকেও বিচার ব্যবস্থার অংশ করা প্রয়োজন।
এই রায়ের প্রেক্ষিতে হয়তো শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত বিষয়টি গড়াতে পারে। কারণ, পকসো আইনের এমন ‘নজিরবিহীন ব্যাখ্যা’ দেশের বহু মামলায় প্রভাব ফেলতে সক্ষম। শেষ পর্যন্ত আইনের ভাষা এবং সমাজের প্রত্যাশার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য স্থাপনই হতে চলেছে বিচারব্যবস্থার বড় চ্যালেঞ্জ।
