ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সংস্কারে বিশ্বভারতীর ভূমিকায় অসন্তোষ বিশেষজ্ঞদের
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
‘কালো বাড়ি’র পর এবার উপাসনা গৃহ। কবিগুরুর সাধের শান্তিনিকেতনের উপাসনা গৃহ সংস্কারের জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা এএসআই কে চিঠি দিল বিশ্বভারতী। ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্র শান্তিনিকেতনের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কি অবস্থায় রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে গতকালই শান্তিনিকেতনে যান এএসআই এর প্রতিনিধিদল। ইতিমধ্যেই শান্তিনিকেতনের কালো বাড়ি সংস্কারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেই সংস্কারের কাজ দেখার পাশাপাশি এই বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্রের অন্যান্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সংস্কার কতটা প্রয়োজন তা খতিয়ে দেখতেই শান্তিনিকেতনে আসেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রতিনিধিরা।
সূত্রের খবর, ক্যাম্পাসের রক্ষণাবেক্ষণের ধরণ নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ওই দল। পরিদর্শনের এই রিপোর্ট শীঘ্রই বিশ্বভারতীর হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে তারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
আর তাদের কাছেই
শান্তিনিকেতনের অন্যতম ঐতিহ্য উপাসনা গৃহের সংস্কারের আবেদন জানিয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। নিয়ম মেনে এএসআই এর কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে বলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর।
সুজিত বসু বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীন এই উপাসনা গৃহের সংস্কারের কাজ হয়েছিল। ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণার আগে ইউনেস্কো প্রতিনিধিদল যখন শান্তিনিকেতনে আসেন সে সময় কিছু সংস্কারের কাজ হয়। তারপর থেকে শান্তিনিকেতনের এই ঐতিহ্যক্ষেত্রের কোনো সংস্কারের কাজ হয়নি। যদিও এই উপাসনা গৃহের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বলে এএসআই কে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে আগামী ৭ মে ঠিক ২৫ বৈশাখের আগে ফের শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে আসতে পারেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্নে আচার্য নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেজ প্রমুখ বিশিষ্টজন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাসে তৈরি করেছিলেন বিভিন্ন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য।
তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কালোবাড়ি, কলের বাঁশি, সাঁওতাল পরিবার, বুদ্ধ, গান্ধী, সুজাতার মূর্তি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে সেগুলি অত্যন্ত
গুরুত্ব সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জটিল সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী অনেক সময় এএসআইয়েরও দ্বারস্থ হয়েছে। তাদের হাত ধরে রবীন্দ্রভবনের শ্যামলী, পাঠভবনের চৈত্য প্রভৃতি মাটির বাড়িগুলি পূনঃসংস্কার হয়েছে। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ক্যাম্পাসের রক্ষণাবেক্ষণ আরও গুরুত্ব পেয়েছে। তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয়েছে হেরিটেজ সেল। তাই রক্ষণাবেক্ষণ খতিয়ে দেখতে মাঝেমধ্যেই এএসআইয়ের প্রতিনিধি দল শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখেন। তার প্রেক্ষিতেই এদিন এএসআইয়ের কলকাতার শাখার বিজ্ঞান বিভাগের আধিকারিকরা হেরিটেজ সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। সেই দলে ছিলেন এএসআইয়ের কলকাতা শাখার ডেপুটি সুপারিনটেনডিং আর্কিওলজিস্ট বিনয় প্রসাদ গুপ্ত, ডঃ মহুয়া উপাধ্যায় সহ আরও এক আধিকারিক। বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত কর্মসচিব অশোক মাহাতো ও শান্তিনিকেতন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ম্যানেজার অনিল কুমার তাদের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখান।বিজ্ঞান বিভাগের দলটি মূলত ক্যাম্পাসে থাকা বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের ম্যুরালগুলি খতিয়ে দেখেন। সেগুলি “কেমিক্যাল প্রসেস” এ সংস্কার করা যায় কিনা তা নিয়েই আলোচনা হয় বলে এক আধিকারিক জানিয়েছেন। যেহেতু এই মুহূর্তে শান্তিনিকেতন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পেয়েছে তাই সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তার জন্য এএসআই সবরকম সহায়তা করতে প্রস্তুত বলেও আধিকারিকরা আশ্বাস দিয়েছেন বলে বিশ্বভারতী সূত্রে জানা গেছে।
শান্তিনিকেতনের রীতি অনুযায়ী প্রতি বুধবার এই উপাসনা গৃহে সাপ্তাহিক উপাসনা হয়। এছাড়া ২৫ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ, মহর্ষি স্মরণ, খৃষ্ট উৎসব উপলক্ষে বিশেষ উপাসনার আয়োজন করা হয় এই উপাসনা গৃহে।
উল্লেখযোগ্য, ১৮৮৮ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমের যে ব্যবস্থাপত্র শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই ব্যবস্থাপত্রের অঙ্গীকার অনুযায়ী এই সময়ে মন্দির উপাসনা গৃহের আকৃতির মধ্যেও মুক্তির একটি ভাব নিহিত থাকতে হবে। যেন বাইরে ও ভিতরে দুদিক থেকেই দুদিককে স্বচ্ছ দেখা যায়। (এজন্যই মন্দিরগৃহটি কাঁচের দেওয়ালে তৈরি)। আশ্রমের অনন্ত রূপ যাতে কোনো আবরণ দ্বারা প্রকাশে বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য শান্তিনিকেতনের চতুঃসীমা বেড়া দিয়ে আবদ্ধ করাও নিষিদ্ধ ছিল মহর্ষির আদেশে। শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির মুক্ত ক্রোড়ে সেই অসীমত্বের মহান ভাবটি মহর্ষি যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেই অঙ্গীকার বা ভাবধারা বজায় রেখে শান্তিনিকেতনের উপাসনা গৃহে সংস্কার কতটা ফলপ্রসু হয় তারই অপেক্ষায় বিশ্বভারতী।
