দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি
সমগ্র ভারতবর্ষের গর্ব রাধানাথ শিকদার আজ তার নিজ ভূমে অবহেলিত। মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ধারণ করেছিলেন এই বাঙালি অথচ তাকেই আজ আমরা ভুলে যেতে বসেছি। ১৮৭০ সালের ১৭ মে আজকের এই দিনটিতে তিনি তার চন্দননগরের বাড়িতে প্রয়াত হন। চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায় যে বাড়িতে তিনি প্রয়াত হন সেই বাড়ির চিহ্নটুকু আজ অবশিষ্ট নেই। এই রাধানাথ শিকদার প্রয়াত হওয়ার পর তার মৃতদেহের কি পরিণতি হয়েছিল তা আজও প্রকাশ্যে আসে নি। তার মৃত্যুর শংসাপত্রও কেউ চোখে দেখেন নি। সারা বিশ্ব থেকে পর্বতারোহীরা মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করার নেশায় ছুটে আসেন অথচ এই মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গ সম্পর্কে যিনি সঠিক তথ্য একদিন তুলে ধরে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক তথ্য সামনে এনেছিলেন তাকেই আমরা আজ ভুলে যেতে বসেছি। শুধু ইতিহাসের পাতা থেকে জানতে পারা যায় রাধানাথ শিকদার মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা মেপেছিলেন। এর বাইরে তার জীবনের অনেক অজানা তথ্যই মানুষ জানেন না।
মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ধারণ ছাড়াও তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তা বাঙ্গালীর গর্ব। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে তাকে একজন স্বাধীনতার সংগ্রামী বললে কোনো অত্যুক্তি করা হবে না। প্রেসিডেন্সির কৃতী ছাত্র রাধানাথ শিকদার শুধু গণিতজ্ঞই ছিলেন না ত্রিকোণমিতিতে তার জ্ঞান সর্বজনবিদিত। হিমালয়ের ১৫ তম শৃঙ্গর উচ্চতা নির্ধারণ করতে গিয়ে যখন বড় বড় গণিতজ্ঞরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন তখন এই বাঙালি মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা মেপে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন। সেই সময় এই শৃঙ্গের উচ্চতা মাপা হয়েছিল ২৯ হাজার ২ ফুট। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভৌগোলিক কারণে এর উচ্চতা আবশ্য কিছুটা বেড়েছে। রাধানাথ শিকদার ব্রিটিশ আমলে যখন দেরাদুনে সার্ভেয়ারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন তখন কাজের বাইরে ব্রিটিশ জজ সাহেবদের বাড়িতে গিয়ে কুলিদের বেগার খাটানোর নির্দেশ আসে। প্রথম ভারতীয় হিসেবে তিনি ব্রিটিশদের এই নির্দেশের চূড়ান্ত বিরোধিতা করেছিলেন। সেদিন তিনি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং শ্রমিকরাও তার কথায় সহমত পোষণ করে মাথা নত না করে সেদিন জজ সাহেবদের বাড়িতে কাজ করতে যান নি। আজ চন্দননগরের অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষ মনে করেন যে সেদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বীজ বপন করেছিলেন এই বীর বাঙালি। সেদিন ব্রিটিশ জজ সাহেব শ্রমিকদের উস্কানিমূলক প্ররোচনা দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করার অভিযোগ এনে রাধানাথ শিকদারকে নির্দেশ দেয়- হয় ক্ষমা চাও, নয়তো ২০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। বীরদর্পে সেদিন তিনি ক্ষমা না চেয়ে ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে ভারতবাসীর মাথা উঁচু করেছিলেন। ব্রিটিশরা সেদিন এই বাঙালিকে ভয় পেয়েছিল তাই এর পরে কোনো কারণ না দর্শিয়ে তাকে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের অফিসে তাকে বদলি করা হয়। ব্রিটিশ দপ্তরে কাজ করার কারণে কলকাতায় নানা রকম সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই সময় ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায় অবস্থিত তার নিজের বাড়ি থেকেই কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। আজ সেই বাড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই। এখন পুরোনো ছবি দেখে জানতে পারা যায় এটাই সেই রাধানাথ শিকদারের বাড়ি। সেদিন চন্দননগরের বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত যাতায়াত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
সবচেয়ে বড় বিস্ময় হল এই মানুষটি ১৮৭০ সালের ১৭ মে প্রয়াত হলেও তার মৃত্যুর শংসাপত্র আজও কেউ দেখেন নি। আজ ভুলেও তাকে কেউ স্মরণ করেন না অথচ তিনি মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা নির্ধারণ করেছিলেন বলেই আজ পর্বত অভিযানের ক্ষেত্রে ওই উচ্চতায় পর্বতারোহীদের কি ধরনের সমস্যা হতে পারে এবং তার সমাধানের জন্য আগাম পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়েছে। চন্দননগরের মানুষও আজ রাধানাথ শিকদারের জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। তাদের এই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কল্যাণ চক্রবর্তীর রাধানাথ শিকদারের জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে চন্দননগরের বুকে গড়ে তুলেছেন 'রাধানাথ শিকদার হিমালয়ান মিউজিয়াম'। কল্যাণ চক্রবর্তী জানান রাধানাথ শিকদারের কোনো ছবি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। হাতে আঁকা একটি তার ছবি পাওয়া যায়। আর সেই ছবিকে অনুসরণ করেই এই মিউজিয়ামে রাধানাথ শিকদারের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে এই সংগ্রহশালার মধ্য দিয়ে। চন্দননগরের বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের দাবি স্কুলের পাঠ্য বইতে রাধানাথ শিকদারের জীবনী স্থান পাক তাতে বাঙালির ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হবে।
