কণাদ মুখার্জি
অর্ধেক আকাশ যখন আলোয় আলোয় ভরা, তখন বাকি অর্ধেক আকাশে ঘনঘন ঘন মেঘের আনাগোনা, বৃষ্টির ভ্রূকুটি। আলোর খর তাপে বাকি অর্ধেক আকাশের জল যে কখন বাষ্প হয়ে উবে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না। তা শুধু বুঝতে পারা যায়, সেই বাষ্প বজ্র হয়ে সজোরে আমাদের ধাক্কা দিয়ে গেলে।
সম্প্রতি সোনম রঘুবংশীকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তোলপাড়। অভিযোগ, মধুচন্দ্রিমায় মেঘালয় বেড়াতে গিয়ে স্বামী রাজা রঘুবংশীকে সুপারি কিলার দিয়ে খুন করিয়েছেন তিনি। সংবাদমাধ্যম মারফত যা জানা যাচ্ছে তা হল, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের বাসিন্দা সোনমের জন্য সুপাত্র খুঁজছিলেন তাঁর পরিবারের লোকজন। সেখানে রাজা রঘুবংশীকে দেখে পছন্দ হয় তাঁদের। দুই পরিবারই ব্যবসায়ী। এর পর, গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোনমের বাড়িতে বিয়ের কথা পাকা হয়ে যায়। গত ১১ মে চার হাত এক হয়ে যায় সোনম ও রাজের। এর কিছু দিনের মধ্যেই, অর্থাৎ ২১ মে থেকে মেঘালয় ভ্রমণ শুরু করে নবদম্পতি। কিন্তু ২৩ মে আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান তাঁরা। ২ জুন উদ্ধার হয় রাজার ক্ষতবিক্ষত দেহ। সোনম তখনও নিখোঁজ। কিছু দিন পর, উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ থেকে সোনম গ্রেফতার হতেই সামনে আসে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ, তিনি তাঁর প্রেমিক রাজ কুশওয়াহা ও রাজের কয়েক জন বন্ধু মিলে খুন করেছেন রাজা রঘুবংশীকে। আর এই ঘটনাই নাড়িয়ে দিয়েছে দেশ-দুনিয়ার খবর নিয়ে আগ্রহীদের একটি বড় অংশকে।
আর্থসামাজিক ভাবে মধ্যবিত্তরাই মূলত এ দেশের সংবাদমাধ্যমের মূল পাঠক, শ্রোতা বা দর্শক। আর সেই মধ্যবিত্ত মানসিকতার মধ্যেই পতি পরমেশ্বরের ধারণার লালনপালন ও কালক্রমে বটবৃক্ষের আকার নেওয়া। সেই ধারণায় বেশ জোরে ধাক্কা দিয়েছেন সোনম। এই শোরগোলের মাঝেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সোনম রঘুবংশীর ভাই গোবিন্দ রঘুবংশীর বয়ান। তাঁর উপলব্ধি, রাজের সঙ্গে সোনমের সম্পর্কের কথা তিনি আগে জানতে পারলে ওদের বিয়ে দিতেন। তাতে তাঁর মা-বাবা আপত্তি করলেও তিনি সোনমকে বলতেন, যাতে সে রাজকে নিয়ে পালিয়ে যায়। তা হলে হয়তো রাজা রঘুবংশীর এই করুণ পরিণতি এড়ানো যেত। সোনম-রাজের সম্পর্কের কথা আগে জানতে পারলে রাজার সঙ্গে কখনও দিদির বিয়ে তিনি হতে দিতেন না বলেই জানিয়েছেন গোবিন্দ।
এই সূত্রেই দু’একটি প্রশ্ন উঠে আসে। পরিবারের সদস্যরা কেন বিয়ের আগে সোনমের মনের খবর টের পেলেন না? সোনমই বা কেন নিজের কথাটুকু বলতে পারলেন না পরিবারের সকলের সামনে? মহিলারা শৈশবে বাবার, তারুণ্যে স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের অধিকারে, গ্রামবাংলায় এখনও এ কথা বেশ প্রচলিত। সেই অগণতান্ত্রিক ‘সূত্র’ কি সোনমের ক্ষেত্রেও খাটে? তার চেয়েও বড় কথা, এক জন মানুষ তাঁর নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা কেন তুলে ধরতে পারবেন না নিজেরই পরিবারের সদস্যদের সামনে?
পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মহিলাদের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে আমাদের দেশে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হয়। কিন্তু সত্যিই সেই অগ্রগতি কতটা সর্বস্তরে পৌঁছেছে তা নিয়েও বছরের পর বছর ধরে প্রশ্ন উঠতে থাকে। যদি অবশ্য মূল প্রশ্নটা ধরতে পারা যায়। মহিলাদের ভোটাধিকারের ধারণার সঙ্গে অনেক দিনই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন পুরুষরা। সেই কাজ অবশ্য সাঙ্গ হয় গোপনে, পর্দার আড়ালে। কিন্তু প্রকাশ্যে যখন মহিলারা নিজের মত জানান তখন?
সুইচ টিপলেই আলো জ্বলে। ঘরের প্রতিটা কোনা আলোয় আলোয় ভরে ওঠে। অন্ধকার সরে যায়। কিন্তু সুইচ টিপলেই এই সমাজের উপরতলা থেকে নীচতলা পর্যন্ত উন্নয়নের আলো বা চেতনার আলো এক লহমায় পৌঁছয় না। সেই সব পৌঁছয় চুঁইয়ে চুঁইয়ে। তা বেশ সময়সাপেক্ষ। আসলে জমিদারি প্রথা শেষ হয়ে গেলেও সেই আমলের নানা নিয়মের ভগ্নাবশেষ এখনও আমাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে। ফলে সেই সব বাধা কাটিয়ে উন্নয়ন-চেতনা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছতে দেরি হয় অনেক। তাতে কেটে যেতে পারে কয়েক প্রজন্মও। আর অন্ধকার থেকে আলোয় এই উত্তরণের মাঝে যাঁরা পড়ে যান তাঁদের বেশিরভাগকেই পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। কেউ কেউ হয়তো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। কখনও ঘটে যায় নানা অপরাধও। যেমনটা হয়তো ঘটেছে সোনম রঘুবংশীর ক্ষেত্রেও।
মাঝে মাঝেই সাহিত্য অনুরাগীদের লেখা বা বক্তব্যে শুনতে পাই, “তমুক এক জন কালজয়ী লেখক। আজ থেকে ৫০ বছর যা লিখেছেন তা আজকের দিনেও ঘটে। একেবারে সত্যদ্রষ্টা ঋষি।“ কিন্তু ‘কালজয়ী’ বলে সত্যিই কি কিছু হয়? আসলে ৫০ বছর আগে সমাজের যে সব নিয়মকানুন ছিল তা এখনও বদলায়নি। মানে যুগোপযোগী হয়ে ওঠেনি। তার ফলে, ৫০ বছর আগেও যে সব বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটত এখনও তা ঘটে। তাই তো এখনও বাস্তবে ‘নিরুপমা’ বা ‘সুবর্ণলতা’দের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় ভূরি ভূরি। তা হলে এখন করণীয়? হয় ভাবনাচিন্তা বদলাতে হবে, না হলে জেলের আয়তন বাড়িয়েই যেতে হবে। নইলে কে বলতে পারে, গোটা ভূখণ্ডই এক দিন সংশোধনাগার হয়ে উঠবে!
(লেখক প্রায় বিশ বছর সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। পেশার টানে গ্রাম থেকে শহরে আসা। ভালবাসেন পড়তে আর অল্পস্বল্প লিখতে।)
