ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায় আজ এমন একটা বাঁক এসেছে, যেখানে ভগবানও হয়তো নিজের পরিচয়পত্র খুঁজে বলছেন, আমি বিজেপির না তৃণমূলের? ভক্তি এখন আর আধ্যাত্মিক নয়, এটা এখন একেবারে নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি! মনে হচ্ছে যেন রামচন্দ্র এবার গেরুয়া রোড শোতে নামছেন, আর জগন্নাথদেব তৃণমূলের স্টার প্রচারক!
একদিকে ‘জয় শ্রী রাম’, এই তিনটি শব্দ শুনলেই এখন আতঙ্ক হয় শাসক দলের। মিছিল, তলোয়ার, বাইক র্যালি, সব মিলিয়ে যেন রামের বর্ণময় নির্বাচন অভিযান! রামনবমী এখন আর শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বিজেপির ‘আধা-মৌলিক’ ভোটব্যাঙ্কে নতুন করে ফাটকাবাজি।
আর জগন্নাথ? আহা, কী ভদ্র, কী বিনয়ী! হ্যাঁ, তিনিই এখন তৃণমূলের ব্র্যান্ড এম্বাসাডর। পুরী ছেড়ে তিনি এখন দীঘায় এসেছেন। দীঘার রথে চড়ে তিনি এখন ভোটের রাস্তায় নামলেন। মুখ্যমন্ত্রীর স্লোগান, ক্যামেরা-প্রেম, চ্যানেল কভারেজ, সবই এক নরম ধর্মীয় ইমেজ গড়ে তুলছে। যেন জগন্নাথ এখন তৃণমূলের ‘অফিশিয়াল ঈশ্বর’!
নিঃসন্দেহে, এই রাজনীতিকীকরণ শুধু দেবদেবীর নামেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের মূর্তিতেও চলছে রঙের রাজনীতি। মণ্ডপে রামচন্দ্রের মূর্তি তৈরি হচ্ছে যেন হিন্দুত্বের পোস্টার বয়; আর তৃণমূল-ঘেঁষা মণ্ডপে জগন্নাথদেব যেন বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির রক্ষাকর্তা। প্রতিমার চোখে যেন দলীয় রঙের ছায়া, সাজসজ্জাতেও রাজনৈতিক বার্তা।
এমনকি কীর্তন, যাত্রা, পালা গান, এসবও এখন হয়ে উঠছে রাজনৈতিক প্রচারের নতুন মাধ্যম। রাম নাম সংকীর্তনের মাঝে গেরুয়া বার্তা, আর জগন্নাথের মাহাত্ম্য প্রচারের আড়ালে শাসকদলের ‘ব্র্যান্ড বিল্ডিং’। আগে যেসব স্থানে ভক্তরা নির্ভয়ে ভগবানের নাম নিতেন, সেখানে এখন তাঁরা খুঁজে দেখেন আশপাশে কোনও ক্যামেরা আছে কি না, কারণ ভক্তি প্রকাশও এখন রাজনৈতিক ব্যাখ্যার শিকার।
এই দুই ভগবান হিন্দু ধর্মের হলেও, এখন তাঁরা যেন দলের মুখ হয়ে উঠেছেন, আর তাই তাঁদের নামেই তৈরি হচ্ছে বিভাজন। রামের নাম শুনলেই কিছু মানুষ ভাবেন, আপনি বিজেপি করেন; জগন্নাথ বললেই আবার অনেকে ভাবেন, আপনি তৃণমূলের লোক। এই দুই দেবতার নাম উচ্চারণেই সমাজে তৈরি হচ্ছে সন্দেহ, দলীয় পরিচয় নিয়ে বাড়ছে সংঘাত। অর্থাৎ, একই ধর্মের দেবতা হলেও, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের ব্যবহার মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।
এত সবকিছুর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে সেই নির্লিপ্ত, নিরপেক্ষ, আধ্যাত্মিক ঈশ্বর! যাঁকে সবাই নিজের মনে স্থান দিতেন। এখন সেই ঈশ্বরকে আগে চিহ্নিত করতে হয়, তিনি রাইট উইং না লেফট উইং? তাঁর নাম বলার আগে ভাবতে হয়, আপনার প্রতিবেশী কোন পার্টির সমর্থক?
এই অবস্থায় আমাদের প্রশ্নটা বড় গুরুত্বপূর্ণ , আমরা কি ঈশ্বরকে আর শুধুই ঈশ্বর হিসেবে দেখতে পারি? নাকি তিনিও আজকাল PR টিমে অন্তর্ভুক্ত? ভক্তের আর্তি নয়, আজ ঈশ্বরের কানে পৌঁছায় স্লোগান ! ভোট চায় বিজেপি, ভোট চায় তৃণমূল। অথচ ঈশ্বর কি চাইছেন, তা হয়তো আজ আর কেউ শুনতেই চায় না।
বিশ্বাস করুন, ঈশ্বর এখন আর মন্দিরে নেই, তিনি এখন ব্যানারে, ট্যাবলোতে, আর হোর্ডিংয়ে। ভোট আসে, যায়, কিন্তু ব্যালটের ছায়ায় আজ ঈশ্বরেরও ঘাম ছুটছে। আগামী নির্বাচনে যদি শোনা যায়, ভোট দিন শ্রীরামকে! অথবা আপনার ভোট, আপনার জগন্নাথ! তাহলে অবাক হবেন না! কারণ ধর্মীয় আস্থা এখন রাজনীতির সবচেয়ে লাভজনক ইনভেস্টমেন্ট।
